আদিবাসীদের অধিকার আন্দোলন ও রাষ্ট্রের নির্লিপ্ততা
এ দেশ থেকে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে একটি জাতি। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য আর ধর্ম বিশ্বাসগুলো। এমন পটভূমিতে আমারা যাই কড়া আদিবাসীদের পাড়াটিতে। দিনাজপুরের একেবারে সীমান্তবর্তী গ্রাম ঝিনাইকুড়িতে এ আদিবাসী পাড়াটির অবস্থান। একসময় এ জাতির হাজার পরিবার বাস করত দিনাজপুর ও রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায়। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় বাঙালিদের দ্বারা এদের পূর্বপুরুষদের ভূমি দখল, ভূমিকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব ও প্রাণনাশের হুমকি এবং সীমাহীন দারিদ্র্যর কাছে পরাস্ত হতে থাকে কড়ারা। ফলে প্রায় বাধ্য হয়েই জীবন বাঁচাতে দেশ ছাড়ে তাদের অনেকে। চলে যায় কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে– ভারতে।
বর্তমানে কড়াদের মাত্র ১৯টি পরিবারে ৮৫জন সদস্য টিকে আছে ঝিনাইকুড়িতে। যারা আছে তাদের অনেককেই হুমকি দেওয়া হচ্ছে ভারতে চলে যাওয়ার। কেননা, তাতে আদিবাসীদের জমিগুলো দখলে নেওয়ার সুবিধা হয় স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী বাঙালি মুসলমানদের।
সাত বছর ধরে খুব কাছ থেকে দেখছি নিশ্চিহ্নপ্রায় এ আদিবাসীদের জীবনপ্রবাহ। একান্তভাবে মিশে জেনেছি তাদের সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, সুখ-দুঃখ, আনন্দ ও সংগ্রামের কথা ।
কড়া গোত্রের প্রধান বা মাহাতো জগেন কড়া। বয়স ৮০-এর মতো। তাঁর দেওয়া তথ্যমতে, এ জাতির মানুষদের আগমন ব্রিটিশ আমলেরও আগে। তখন এখানটায় কোনো বাঙালির অস্তিত্ব ছিল না। চারপাশের গহীন বন কেটে কড়া, সাঁওতাল, ওরাওঁসহ অন্যান্য আদিবাসী এখানে আবাদি জমি তৈরি করে চাষবাস শুরু করে। আর এখন অধিকাংশ জমিই বাঙালিদের দখলে।
১৯৯৬ সাল থেকে ৫২ একর জমি নিয়ে কড়াদের সঙ্গে মামলা চলছে স্থানীয় হান্নান ও কালামের। কিন্তু অদ্যাবধি তা নিষ্পত্তি হয়নি। মাঝে-মধ্যেই তারা দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে আদিবাসীদের জমিগুলো। নানা অজুহাতে হুমকিও দেয় দেশত্যাগের।
কড়ারা পরিশ্রমী ও কৃষি পেশায় পারদর্শী। ভাদ্র-আশ্বিন এদের অভাবের মাস। আগে এ সময়টাতে তারা জমির আগাছা পরিষ্কারের কাজ পেত। কিন্তু রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে জমিতে এখন তেমন আগাছা হয় না। তাই এ সময় কৃষিপেশার আদিবাসীরা কর্মহীন হয়ে পড়ে। এ সময়টায় সরকারের কোনো রিলিফ সুবিধাও পায় না তারা। ফলে মহাজনদের কাছে আগাম শ্রম বিক্রি করে যা পায় তাই দিয়েই পরিবার চালিয়ে নেয় কড়ারা। সমতলের আদিবাসীদের ভাগ্যোন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ তহবিল চালু থাকলেও তার কোনো সুফল তারা পায়নি। ফলে স্থানীয় এনজিও ও মহাজনদের সুতোর টানে ঘুরপাক খাচ্ছে কড়া আদিবাসীদের জীবনপ্রবাহ।
কড়া পড়ায় আদিবাসী শিশু রয়েছে ৩০ জনের মতো। এ বছর দুজন এসএসসি পাশ করলেও অধিকাংশই ৬ষ্ঠ শ্রেণি পেরোতে পারেনি। দারিদ্র্য ছাড়াও স্থানীয় বিদ্যালয়ে আদিবাসী শিক্ষক না থাকা এবং শিক্ষামাধ্যমে নিজেদের মাতৃভাষার প্রচলন না থাকাই এর প্রধান কারণ। এ ছাড়া কড়া গোত্রে দশজনের বয়স ৬০ অতিক্রম করলেও তাঁরা পায় না সরকারের বয়স্কভাতা।
১৯৭১ সালে এ পাড়ার থোপাল কড়া, কিনা কড়া ও সাতান কড়া অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ির পানিঘাটায় ‘হায়ার ট্রেনিং’ শেষে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন সাত নম্বর সেক্টরে। কিন্তু নানা কারণে এই তিন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো কাগুজে সনদ পাননি। এ নিয়ে অবশ্য তাঁদের কোনো খেদ নেই।
ভ্যান গাড়ি চালিয়ে উর্পাজন করতেন মুক্তিযোদ্ধা থোপাল কড়া। কিন্তু এখন তিনি অসুস্থ। চলছেন লাঠিতে ভর দিয়ে। কেউ তাঁর খোঁজও রাখে না। নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের। যেটুকু জমি আছে তা নিয়েও চলছে মামলা। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন সেই স্বাধীন দেশ থেকে তাঁকেই ভারতে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব কথা বলতে গিয়ে এ মুক্তিযোদ্ধা অঝরে কাঁদেন।
কড়াদের নিয়ে উপরের তথ্যগুলো নিজের অভিজ্ঞতায় দেখা সমতলের একটি আদিবাসী জাতির টিকে থাকার বর্তমান চিত্র মাত্র। এ দেশে বসবাসরত আদিবাসীরা সত্যিকারভাবে কেমন আছে? এ থেকে কিছুটা হলেও তা অনুমান করা যায়।
সরকারি ভাষায় এ দেশে কোনো ‘আদিবাসী’ নেই। ২০১১ সালে এমন ঘোষণা দেওয়ার ফলে সমতল ও পাহাড়ে আদিবাসীদের ওপর সংখ্যাগুরু বাঙালিদের একশ্রেণির অত্যাচার, নির্যাতন ও অবহেলার মাত্রা কতটা বেড়েছে সে খবর কি আছে রাষ্ট্রের কাছে?
আদিবাসী প্রসঙ্গ আসলেই অনেকে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। বলেন, আদিবাসীরাই কি আদি বাসিন্দা? তাহলে বাঙালিরা কী? ‘আদিবাসী’ বা ‘ইন্ডিজেনাস’ শব্দের অর্থে কিন্তু শুধু আদি বাসিন্দার বিষয়টিই বিবেচ্য নয়; বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, একটি জাতির স্বতন্ত্র্য ভাষা, সংস্কৃতি, আচার ও সমাজব্যবস্থা প্রভৃতি। এর সবগুলোই আদিবাসীদের রয়েছে। তা ছাড়া ইতিহাস বলে, এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দারা কোনোকালেই বাঙালি ছিল না।
কিন্তু প্রশ্ন জাগে, আদিবাসী জাতিগুলোর ওপর একশ্রেণির বাঙালিদের ভূমিকেন্দ্রিক অত্যাচার আর নির্যাতন কি ‘আদিবাসী’ শব্দ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে জায়েজ হয়ে যাবে? পিছিয়ে পড়া আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানো কি রাষ্ট্রে দায়িত্ব নয়?
যখন এ লেখা লিখছি তখন চলছে ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস ২০১৬’ উদ্যাপনের প্রস্তুতি। তবে সেটি সরকারিভাবে নয়; পালিত হচ্ছে বেসরকারিভাবে।
কেন এই দিবস? সেটি জানতে খানিকটা পেছনে দৃষ্টি ফেরাতে হবে।
জাতিসংঘ প্রথম ১৯৯৩ সালকে ‘আদিবাসী বর্ষ’ ঘোষণা করে। অধিকারবঞ্চিত আদিবাসীদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। সে লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হয় ৯ আগস্টকে ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ হিসেবে পালনের।
কিন্তু বাংলাদেশে এ দিবসটি বেসরকারিভাবেই উদ্যাপিত হয়ে আসছে ২০০৪ সাল থেকে। বেসরকারিভাবে পালিত হলেও এ দিবসের অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নিয়েছেন সুধীসমাজ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।
শুধু তা-ই নয়, বিশ্ব আদিবাসী দিবসের বিভিন্ন প্রকাশনায় বাণী দিয়ে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন ২০০৯ সালে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, ২০০৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া, ২০১০ সালে খাদ্যমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সংসদ উপনেতা এবং জাতীয় পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক সাজেদা চৌধুরী প্রমুখ।
আওয়ামী লীগ সরকার আদিবাসীদের দাবিগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল থাকলেও উল্টো ঘটনা ঘটে ২০০৮ সালে। সে সময় হঠাৎ করেই আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে অস্বীকার করা হয়। পরবর্তীতে ওই সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত রূপ পায় বর্তমান সরকারের সময়ে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে। সংশোধিত সংবিধানের উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশ নামে ২৩(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।’
আবার ৬ নং অনুচ্ছেদে বাংলাদেশে ‘বাঙালি’ ছাড়া অন্য সব মানুষের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে: ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।’ ফলে সেখানে অন্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয় পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়।
একইভাবে ২০১০ সালের ১২ এপ্রিল প্রণীত হয় ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান’ আইনটি। এর ২(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ অর্থ তফসিলে উল্লেখিত বিভিন্ন আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও শ্রেণীর জনগণ।
একদিকে সরকার বলছে দেশে কোনো আদিবাসী নেই, আবার একই আইনে বলা হচ্ছে, আদিবাসীরাই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী।
বিভিন্ন সরকারি নথির দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলের এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন ও সরকারি দলিলে ‘আদিবাসী’ শব্দটির ব্যবহার রয়েছে। পার্বত্য চট্রগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০, পূর্ববঙ্গ জমিদারি দখল ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০, আয়কর আইনসহ সরকারি বিভিন্ন পরিপত্র, দলিল ও হাইর্কোটের রায়েও ‘আদিবাসী’ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে।
সরকার আদিবাসীদের অস্বীকার করলেও ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ১৮(২) অনুচ্ছেদে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করে উল্লেখ করা হয়েছে: ‘পার্বত্য চট্টগ্রামসহ অনগ্রসর অঞ্চলসমূহের উন্নয়নে বর্ধিত উদ্যোগ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, আদিবাসী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের অধিকারের স্বীকৃতি এবং তাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনধারার স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ ও তাদের সুষম উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।’
ইশতেহারের ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু, অনুন্নত সম্প্রদায় ও অনগ্রসর অঞ্চল’ শীর্ষক অনুচ্ছেদেও ‘আদিবাসীদের জমি, জলাধার এবং বন এলাকায় সনতনী অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশন গঠন’ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান’ আইনমতে আদিবাসীরাই যদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হয়, তবে তো সরকার বলেই দিচ্ছে, এ দেশে আদিবাসী আছে। একই সঙ্গে এটিও স্পষ্ট যে কোনো এক বিশেষ কারণে তাদের ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলা হচ্ছে।
বিশেষ সে কারণটি কী? সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো সরকারি বক্তব্য না থাকলেও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত মতামত ও তথ্য বিশ্লেষণে বিশেষ বাহিনীর প্রতিবেদনের কথা জানা যায়; যার ওপর ভিত্তি করে আদিবাসীদের মতামতকে উপেক্ষা করে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
কিন্তু আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানে সরকারের সমস্যা কোথায়?
এ বিষয়ে ২০১২ সালের ৫ আগস্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তজার্তিক কমিশনের সদস্য ইফতেখারুজ্জামান জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী থেকে চাপ এসেছে যে, যেসব দেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সে দেশে আদিবাসী নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে, শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের অংশগ্রহণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হবে। আর তাই আদিবাসীদের সংজ্ঞাটিও বদলে ফেলা হয়েছে।” (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৫ আগষ্ট ২০১২)
আরও তথ্য পাওয়া যায় চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের বক্তব্যে। তিনি বলেন, “প্রথমত, আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে এই জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়, যা সরকার বোঝা মনে করে। দ্বিতীয়ত, সাংবিধানিক স্বীকৃতির সাথে আদিবাসীদের ভূমির অধিকাররসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে যা হয়তো সরকার দিতে চায় না। তা ছাড়া আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেওয়ার সাথে সাথে সরকারকে অর্ধশতাধিক শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। যার মধ্যে রয়েছে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও নিজস্ব সংগঠন করার অধিকার।” (সাপ্তাহিক, ৭ জুলাই ২০১১)।
কাজেই যদি দেখানো যায় যে এ দেশে কোনো আদিবাসী নেই, তাহলে আদিবাসীদের স্বার্থ সংরক্ষণ বা অধিকার প্রতিষ্ঠার ওই সব শর্ত পূরণেরও প্রশ্ন থাকে না।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরের কথা। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির শান্তিচুক্তি হয়। ফলে পাহাড়ে কয়েক দশকের সংঘাতের অবসান ঘটে। এ চুক্তির জন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ইউনেসকো শান্তি পুরস্কার’ লাভ করেন। কিন্তু সে শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এখনও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি সরকার।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান এখনো প্রায় ক্ষমতাশূন্য। সরিয়ে নেওয়া হয়নি আর্মি ক্যাম্পগুলো। যে নির্দেশনার বলে সেনাবাহিনী পার্বত্য অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, তাও বাতিল করা হয়নি। ভূমিবিরোধের নিষ্পত্তি হয়নি অদ্যাবধি; বরং নতুন করে ভূমিবিরোধ তৈরি হচ্ছে।
পার্বত্য অঞ্চলে সেটেলার বাঙালিদের পুনর্বাসনের সময় প্রতিটি পরিবারকে কিছু জমির মালিকানাসংক্রান্ত কবুলিয়তনামা দেওয়া হয়েছিল। সেগুলোর অধিকাংশই তারা নিয়মবহির্ভূতভাবে বিক্রি করে দিয়েছে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠানের কাছে। বর্তমানে এই প্রভাবশালী চক্রের মাধ্যমে পাহাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন প্রকল্প। পার্বত্য বিষয়ক সংসদীয় কমিটির অনুসন্ধানেও বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য।
তাই শুধু সেটেলার বাঙালিরাই নয়, পাহাড়ে এখন আদিবাসীদের বিরুদ্ধে শক্তি হিসেবে কাজ করছে এই প্রভাবশালী ব্যবসায়ী চক্রটিও। এ ধরনের ভূমি দখলের কারণে সাজেক, রামগড়, মহালছড়ি, বরইতলীতে সংঘাত হয়েছে। এবং এখনো তা থেমে নেই। এভাবেই আদিবাসীরা পাহাড়ে হারাচ্ছে ভূমির অধিকার। বাড়ছে রক্তপাত। বাড়ছে আদিবাসীদের কান্না।
পাহাড়ি-পাহাড়ি দ্বন্দ্ব, পাহাড়ি-বাঙালিদের রাজনৈতিক ইন্ধনে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলে। বাড়ছে আদিবাসী হত্যা, অপহরণ ও ধর্ষণের ঘটনা। সমতলে আদিবাসীদের ভূমি দখল, ভূমিকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বে হুমকি, হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে কয়েকগুণ। এভাবে গোটা দেশের আদিবাসীরাই আজ অবহেলা, বঞ্চনা আর অত্যাচারের মুখে হারিয়ে ফেলছে নিজেদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকু।
সরকারের ‘ভিশন ২০২১’-এর লক্ষ্যে এগোতে আদিবাসীদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা কোনোভাবেই সমীচিন হবে না। তাই উচিত হবে আদিবাসীদের স্বীকৃতি প্রদানসহ তাদের ভূমি অধিকার, শিক্ষা ও জীবনযাপনের অধিকারগুলো বাস্তবায়ন করা।
আদিবাসীরা এখনও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে– এ সরকারের আন্তরিকতাতেই সম্ভব তাদের অধিকার নিশ্চিত করা।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ২৪.কমে , প্রকাশকাল: ৯ আগষ্ট ২০১৬
© 2016 – 2018, https:.