পাকিস্তান থেকে যেভাবে পালিয়ে এসেছিলেন তাঁরা
১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ তখন শুরু হয়ে গেছে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে নিযুক্ত অনেক বাঙালি অফিসার তখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে চলে আসেন। অতঃপর তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। জীবন বাজি রেখে কীভাবে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন তারা?
ওই সময় পশ্চিম পাকিস্তানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অফিসারদের মনোভাব কেমন ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তরগুলোও ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই এ নিয়ে বিভিন্ন সময় মুখোমুখি হই তিন জন কমান্ডারের। তাদের বলা ঘটনাগুলোই আমাদের কাছে ইতিহাসের অংশ হয়েই থাকবে।
কিলো ফ্লাইট নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ের অবিশ্বাস্য এক যুদ্ধাভিযানের ইতিহাস। দুঃসাহসিক ওই অভিযানের এক অগ্রসেনানী বীর মুক্তিযোদ্ধা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম বীর উত্তম। তিনি তখন ছিলেন রাওয়ালপিন্ডিতে। জীবদ্দশায় তিনি বলেন পালিয়ে আসার ঘটনাটি। ঠিক এভাবে,
“২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যায় নামে পাকিস্তানি সেনারা। বিসিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, অল ইন্ডিয়া রেডিওর খবরে গণহত্যার বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। এর মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানে থাকা বাঙালি বৈমানিক সবার ফ্লাইট বাতিল করে গ্রাউন্ডেড করে রাখা হয়।
এপ্রিলেই বেরিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করি। মে মাসে ছুটির আবেদন করি করাচি যাওয়ার। ওখানে কয়েক দিন ঘুরে আসতে চাই। কারণ বিবেচনা করে সাত দিনের ছুটিও মঞ্জুর হয়। দুটো টিকিট কাটলাম। রাওয়ালপিন্ডি টু করাচি, করাচি টু রাওয়ালপিন্ডি। করাচি গিয়ে অফিসার্স মেসে উঠলাম। কয়েক দিন খুব ঘুরে বেড়ালাম। এদিকে ঢাকায় যাওয়ার টিকিট খুঁজছি। বহু কষ্টে এক বন্ধু একটি টিকিট কিনে আনে।
যেদিন রাওয়ালপিন্ডিতে ফিরে যাওয়ার কথা ওই দিনই এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকার বিমানে চড়ে বসি। মূলত এটাই ছিল আমার প্ল্যান। বর্ডার দিয়ে চোরের মতো না গিয়ে রাজার মতো দেশে চলে যাবো। একাত্তরের জুন মাসের ৩ তারিখ বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিটে পিএআই’র ফ্লাইটে ল্যান্ড করি ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে।”
ঢাকায় এসেই গ্রেফতার হন শামসুল আলম। অতঃপর তার ওপর চলে নিদারুণ ও অমানবিক নির্যাতন। সেসব কথা বলতে গিয়ে বারবার অশ্রুসিক্ত হন তিনি।
তার ভাষায়, “একটা গাড়িতে তারা আমাকে তুলে ক্যান্টনমেন্টের এক নির্জন জায়গায় নিয়ে যায়। ওখানে একটা ছোট্ট রুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। খুব অন্ধকার রুমটায়। গাদাগাদি করে অনেক লোক মেঝেতে শুয়ে আছে। মিটমিট করে একটা হারিকেন জ্বলছে। এক কোনা থেকে একজন (পরে জেনেছি উনি মেজর আওলাদ) হাত দিয়ে চুপ থাকার ইশারা করে শুয়ে পড়তে বলে। আমি তাই করি।”
এরপরই কি টর্চার শুরু করে?
“হ্যাঁ। অনেকক্ষণ পর দরজায় আওয়াজ।
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম সাব কোন হে?
উঠে দাঁড়ালাম, সামনে গেলাম।
‘আপ বাহার লিকে’
বাইরে গেলাম। রাত তখন। চারপাশে খানিক চাঁদের আলো। হেঁটে যাচ্ছি। এমন সময় পেছন থেকে এক সোলজার লাঠি দিয়ে দারাম করে একটা বাড়ি মারে। পড়তে গিয়েও পড়লাম না।
বলে, ‘বানচোদ, সামনে দেখ।’
সামনে আরও আট–দশ জন সোলজার। চাঁদের আলোয় মুখগুলো মোটামুটি দেখা যায়। ভেরি ইয়াং। বয়স ২৪–২৬ হবে।
ওরা অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে। ক্রমাগত সব উত্তর দিচ্ছি।
হঠাৎ একজন বলল, ‘আর কত প্রশ্ন করবি।’
বলেই সে আমার পিঠে লাঠির বাড়ি দিতে থাকে। সবাই মিলেই মারছে। সব সহ্য করেও দাঁড়িয়ে থাকি।
ওরা মারছে আর বলছে, ‘শালা শেখ মুজিবকা বাচ্চা।’
শেখ মুজিবের ছেলে বা সন্তান আমি! শুনে কেন জানি ওই মারটাই আমার কাছে গর্বের হয়ে ওঠে। আজ পর্যন্ত যার জন্য আমি গর্ববোধ করি। এই অনুভূতিটা ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না।
ওই রুমে অনেক সিনিয়র অফিসার ছিলেন। কেউ স্কোয়াড্রন লিডার, কেউ মেজর। তিন মাস আগেই ধরে এনেছে তাদের। শমসের মবিন চৌধুরীও ছিলেন। সবার ওপরই নির্যাতন চলতো। প্রত্যেক সন্ধ্যায় ওরা পেটাতে আসতো। এটা ছিল একটা রুটিন। মাসখানেক এভাবেই নির্যাতন চলে। তখন শুধু মৃত্যুর প্রহর গুনতাম।
শেষ পর্যন্ত কি আপনাকে ওখানেই রেখেছিল?
তিনি বলেন, “না। জুলাই মাসে একদিন চোখ বেঁধে জিপে তুলে নেয়। ভাবলাম, হয়তো গুলি করে শেষ করে দেবে। ক্রিসেন্ট লেকে ঢুকতেই বাঁ–দিকের প্রথম বাড়িটায় নিলো। এখন ওটা পার্লামেন্ট ভবনের বিল্ডিংয়েরই অংশ। তখন ওটা ছিল সেন্ট্রাল ইন্টারোগেশন সেন্টার। চোখ খুলতেই জায়গাটা চিনে ফেলি।
রাতের দিকে পাকিস্তানি আর্মির এক মেজর আসে। তিন–চারটা সাদা কাগজ আর কাঠপেন্সিল এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘তোমার স্টেটমেন্টটা একটু লেখো। আমরা জানতে চাই তুমি কেন পালিয়ে এসেছিলে? কী তোমার উদ্দেশ্য? কী তোমার আদর্শ? কারা তোমাকে সাহায্য করেছে আসার জন্য? তোমার প্ল্যান কী ছিল?’
সত্য কথা লিখলে তোমাকে রিলিজ করে দেবো বলেই চলে গেলেন।
অনেক চিন্তা করে লিখলাম এমন, ‘২৫ মার্চের ঘটনার পর খুব আপসেট হয়ে গেছি। বাবা–মা ও ভাইবোনদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। এত উতলা হই যে চলে আসছি। ছুটি তখন দিচ্ছিলো না। তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে এসেছি, বাবা–মা, ভাইবোনদের দেখার জন্য।’
সকালে মেজর আসে। স্টেটমেন্টটা পড়েই ছিঁড়ে ফেলে বলে, ‘বাকোয়াজ লিখছো’।
এভাবে তিন দিন একই কথা লিখলাম।
চতুর্থ দিন এসে বললো, ‘তুমি আজ থেকে সব কাপড় খুলে ফেলবে। নেকেড হয়ে থাকবে’।
গায়ে একটা পাঞ্জাবি ছিল, খুলে ফেললাম। ওখানে বসা বা শোয়ার উপায় ছিল না। শুধুই দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। এরপর আবারও কাগজ দিলো। একই জিনিস লিখলাম। ছিঁড়ে ফেললো।
তখন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। শরীর অবশ হয়ে আসছে। খুব ক্লান্ত লাগছে। ধরেই নিয়েছি মারা যাবো।
ওই সময় আরেকটা কাগজ চেয়ে নিলাম। এরপর বহু চিন্তা করে নিজেই লিখলাম নিজের ডেথ ওয়ারেন্ট এভাবে, ‘আই ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, পাক–৪৯২১ কেম টু ইস্ট পাকিস্তান উইথ এন ইনটেনশন টু জয়েন ফ্রিডম স্ট্রাগল।’ নিচে নাম লিখে সিগনেচার দিয়ে দিলাম।
তখন আমাকে খুব ভালো খাওয়াল। বুঝে নিলাম এরপরই হয়তো আমার মৃত্যু ঘটবে।
কিন্তু না! একদিন পরই ওরা চোখ বেঁধে আমাকে আগের রুমটাতে রেখে আসে। তিন দিন পর এক সন্ধ্যায় এক ফ্লাইং অফিসার আসে একটি চিঠি নিয়ে। সেটা ছিল মূলত আমার চার্জশিট। মার্শাল ল’ ৩৯–সি ধারায় বিচারের মুখোমুখি হতে হবে আমাকে।”
তারিখটা ১৪ আগস্ট। অবাঙালি গ্রুপ ক্যাপ্টেন মাসুদ ছিলেন শামসুল আলমদের অধিনায়ক ও বেইস কমান্ডার। তিনি তার সঙ্গে দেখা করেন। সব ঘটনা শুনে মাসুদ বলেন, ‘তোমাকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনা হয়েছে। এখন তোমাকে পাকিস্তান ফিরে যেতে হবে। ভারতের সঙ্গে শিগগিরই যুদ্ধে জড়াতে যাচ্ছি। এ কারণেই আমাদের অনেক পাইলট প্রয়োজন।
মনে মনে এ সুযোগটি কাজে লাগাতে চান শামসুল আলম। গায়ের পোশাক খুলে তাকে শরীরজুড়ে বেত্রাঘাতের নির্যাতনের চিহ্নগুলো দেখান তিনি। গোটা শরীরেই ছোপ ছোপ রক্ত জমাট বাঁধা ছিল তখন। তিনি এক মাসের ছুটি চান। কিন্তু ওই গ্রুপ ক্যাপ্টেন পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে এয়ারফোর্সে রিপোর্ট করার শর্তে তাকে এক সপ্তাহের ছুটি দিয়ে মুক্ত করে দেন। এভাবেই প্রাণে বেঁচে যান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম।
মুক্তি পেয়ে প্রথমে বাবা–মায়ের সঙ্গে দেখা করেন। অতঃপর কয়েকজন গেরিলার সহযোগিতায় প্রথমে আগরতলায় এবং পরে কলকাতায় চলে যান।
আরেক মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল এস আই এম নূরুন্নবী খান (বীরবিক্রম)। একাত্তরে ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট। জানুয়ারিতে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে নূরুন্নবী খান চলে যান পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে, কোয়েটা স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকসে। ২৫ মার্চ পর্যন্ত চলে ওই ট্রেনিং। এই বীর এখন প্রয়াত। কিন্তু তার বলা কথাগুলোই একাত্তরের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েই থাকবে।
পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক প্রস্তুতি ও জেনারেলদের মনোভাব প্রসঙ্গে একটি অজানা ঘটনার কথা তিনি তুলে ধরেছিলেন যেভাবে, “কোয়েটা তখন বিভিন্ন কোর্সে প্রায় ১২–১৪শ’ আর্মি অফিসার অবস্থান করছিল। সেনাবাহিনীর কমান্ডোদের কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল মিঠ্ঠা খান। একদিন উনি কনফারেন্স রুমে সবাইকে ডাকলেন। বক্তৃতার একপর্যায়ে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রয়োজনে এক মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করা হতে পারে বলে উল্লেখ করে এর জন্য অফিসারদের মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন। আর্মি ল্যাঙ্গুয়েজে এটাকে বলে ‘মিশন’ দেওয়া।”
কথা শুনে আমি ঠিক থাকতে পারি না। দাঁড়িয়ে বলি– “স্যার, আমি কি জানতে পারি পাকিস্তানের কোন পার্টে এই কিলিং করার প্রয়োজন হতে পারে? প্রশ্ন শুনে জেনারেলের মাথা যায় গরম হয়ে। উত্তর না দিয়ে উনি আমাকে প্রশ্ন করেন– ‘আর ইউ ফরম ইস্ট পাকিস্তান? বলি– ‘ইয়েস। আর ইউ এ বেঙ্গলি? বলি– ‘ইয়েস স্যার।’ আর ইউ এ আওয়ামী লীগার? আমি বলি– ‘সরি স্যার। দিস ইজ অ্যান আর্মি ইনস্টিটিউট। হাউ ক্যান আই বি এ আওয়ামী লীগার।”
উনি উত্তেজিত হয়ে যান। বলেন– “ইউ অফিসার সাটআপ অ্যান্ড সিটডাউন। তখন পাশে বসা সহকর্মীরা হাত ধরে আমাকে বসিয়ে দেয়। ওইদিনই বুঝেছিলাম ওরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। বরং আর্মি ক্র্যাকডাউন ঘটাবে।”
ওদের সামরিক প্রস্তুতিটা কেমন ছিল?
নূরুন্নবী বলেন– “কোয়েটায় ছিল সিক্সটিন রিজার্ভ ডিভিশন। একটা আর্মির লাস্ট রিসোর্স হলো রিজার্ভ ডিভিশন। কিন্তু দেখলাম কয়েক দিন পরপরই রিজার্ভ থেকে কয়েক ইউনিট ইস্ট পাকিস্তানে পাঠানো হচ্ছে। এমন কী ঘটছে সেখানে রিজার্ভ থেকে সেনা পাঠাতে হবে! আমরা গোপনে এসব নিয়ে আলোচনায় বসতাম। একসময় পাকিস্তান থেকে পালানোর পরিকল্পনা আঁটি।
করাচির অর্ডিন্যান্স মেসে ছিলাম আমরা। এরপর ২৭ মার্চ সকালের দিকে যাই আর্মি ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেকেন্ড কমান্ডো ব্যাটালিয়ানকে অপারেশনের জন্য তখন ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। এক পাশে ফলিং করিয়ে তাদের ব্রিফ করছেন এক অফিসার। উর্দুতে বলছিলেন– ‘হিন্দুদের দিয়ে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার কাজে নেমেছে ইন্ডিয়া। বাঙালি মালাউনদের মারার জন্য আমার যাচ্ছি। দেশমাতৃকার জন্য এটা তোমাদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ। ওখানে আমরা শুধু মাটি চাই। মানুষের প্রয়োজন নেই। বাংলায় কথা বলার মতো মানুষ আমরা রাখবো না।’
ট্রানজিট ক্যাম্পে সাদেক নেওয়াজ নামে এক বাঙালি সুবেদারকে পাই। আমার ইচ্ছার কথা শুনে উনি বলেন– ‘সর্বনাশ স্যার। ঢাকা যাবেন না। সেখানে সব মাইরা ফেলছে। দুই ডিভিশন তো নিজ হাতে পাঠাইছি। ওরা তো মানুষ রাখবো না স্যার।
বললাম, ‘বাঁচার জন্য না, কিছু করার জন্য যাচ্ছি।’
শুনেই মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর একটা চিরকুটে নাম, আর্মি নম্বর আর ডেস্টিনেশন লিখে দিলেন। তখন ওটাই ছিল বিমানের টিকিট। দেশে নামতেই তেজগাঁও এয়ারপোর্টকে মনে হলো যুদ্ধক্ষেত্র। সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন আফসার। আমরা উঠি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে, অর্ডিন্যান্স মেসে। দেখলাম কচুক্ষেতে লাশ পড়ে আছে। ক্যান্টনমেন্টের এদিক ওদিক জটলা। জায়গায় জায়গায় আর্মি ট্রুপস। কোন গ্রুপ কোথায় যাবে সে ডিউটি ভাগ করা হচ্ছে। চলছে ব্রিফিংও।’
সাবসেক্টর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ আলম বেগ। ক্যাপ্টেন বেগ নামে অধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (এসএসজি)-এর একজন এলিট কমান্ডো। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। কয়েক দিনের ছুটিতে দেশে আসেন। সুলতান সাহেব ও নূর মোহাম্মদসহ কয়েকজনের সঙ্গে মিটিং হয় তার। পরিকল্পনা হয় দেশে খারাপ কিছু ঘটার আগে তারাই করাচিতে তাকে মেসেজ পাঠাবেন। তখন ফিরে এসে তাদের সঙ্গে যুক্ত হবেন বেগ।
তিনি বললেন যেভাবে, ‘ হঠাৎ একদিন কমান্ডিং অফিসার টি এ খান একটি টেলিগ্রাম হাতে ছুটে আসেন। টেলিগ্রামে লেখা– ‘মাদার সিরিয়াস কাম শার্প।’বুঝে গেলাম এটি নূর মোহাম্মদ ভাই পাঠিয়েছেন। ‘মাদার’ মানে মাতৃভূমি। আর ‘সিরিয়াস’ লিখলে বুঝতে হবে যেভাবেই হোক ফিরে যেতে হবে।
টি এ খান ছুটি দিতে চাইলেন। কিন্তু আমি নিজেকে সংযত রাখলাম। ‘মায়ের চেয়ে দেশ আগে’– এমন উত্তর শুনে অবাক হয়ে উনি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। পালিয়ে যাবো এটা বুঝতে দিলাম না তাকে। কারণ ওরা নানাভাবে আমাদের সন্দেহ করতো।
ফরমাল ছুটি না নিয়েই পালানোর পরিকল্পনা আঁটছি। টাকার প্রয়োজনে শখের মোটরসাইকেলটাও বিক্রি করি নয়শত টাকায়। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল অলি। দেশ নিয়ে সেও চিন্তিত। পরিকল্পনার কথা শুনে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলো। রাজি হলাম। কিন্তু প্লেনের টিকিট তো নাই। অলরেডি পাকিস্তান থেকে লোকজন আসা বন্ধ। শুধু হাজিদের ফ্লাইট ওপেন ছিল।
কী করি?
তখন মনে পড়ে লেফটেন্যান্ট ইমতিয়াজের কথা। পাকিস্তানের বাইশ ফ্যামিলির, ধনী পরিবারের সন্তান। চেরিয়ট ট্রেনিংয়ে আমি ছিলাম তার ট্রেনার। ওই সময় সে প্রায় ৬০ ফিট পানির নিচে চলে যায়। ফলে আনকনশাস অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে প্রাণে বাঁচিয়েছিলাম। সেই থেকেই পারিবারিকভাবে একটা বিশ্বস্ত সম্পর্ক ছিল তার সঙ্গে। পাঞ্জাবি হলেও তার কাছেই সাহায্য চাইলাম। সেও সবকিছু গোপন রেখেছিল। পাকিস্তান এয়ারলাইন্সে চাকরি করতেন তার এক আত্মীয়। তার মাধ্যমে দুটো টিকিট জোগাড় করে দেন ইমতিয়াজ। রাত দুটোর ফ্লাইটে পাকিস্তান থেকে রওনা হয়ে ৪ মার্চ ১৯৭১ তারিখ ভোরে পৌঁছি ঢাকায়।’
ক্যাপ্টেন বেগ পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। প্রথমে নয় নম্বর সেক্টরের অপারেশনাল কমান্ডার। পরে তাকে শমশেরনগর সাবসেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
একাত্তরের এ বীর মুক্তিযোদ্ধারা পৌরাণিক কোনও চরিত্র নয়, বরং বাঙালি বীর। তাঁদের রক্ত, ঘাম, ত্যাগে সৃষ্ট বাংলাদেশ আজ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আজকের সবকিছুই আগামীর ইতিহাসের অংশ হবে তা নয়, কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনাদিকাল পর্যন্ত আমাদের আলোড়িত করবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ট্রিবিউনে, প্রকাশকাল: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
© 2024, https:.