কলাম

দেশে বেড়াই: আনন্দ আর সচেতনতায়

যুগে ভ্রমণ সংশ্লিষ্ট তথ্যের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটফর্ম হওয়ার কথা ছিল পর্যটন মন্ত্রণালয় বা তাদের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড পর্যটন করপোরেশনের। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি হয়নি

ঋতুবৈচিত্র্যে বাংলাদেশ সত্যি অপরূপ। শীতে যে পাহাড় দেখলে শুষ্ক ও রুক্ষ মনে হয়; বর্ষার পর ওইসব পাহাড়ই সবুজ স্নিগ্ধতায় সজীব হয়ে ওঠে। মানুষ ও প্রকৃতির বৈচিত্র্যের যেমন শেষ নেই, তেমনি এ দেশে ঘুরে বেড়ানোর জায়গারও অভাব নেই। একেক জায়গার প্রকৃতি, মানুষের জীবনযাত্রা ও আচার আমাদের মনকে একেকভাবে স্পর্শ করে।

ভ্রমণের অভিযান শুধু পর্বতের চূড়া আর সমুদ্রের তরঙ্গ ফেনাই নয়; ভ্রমণ সেখানেও, যেখানে নিভৃতে একটি ছোট্ট মটরফুল তার আশ্চর্য নীল রঙ মেলে ফোটে, দূর জনপদের ছোট্ট বাজারের প্রান্তে ক্লান্ত বৃদ্ধা একডালি শামুক বেচতে বসে, ছোট্ট পুঁটিমাছটি মৃতচোখে তাকিয়ে থাকে খ্যাপলা জালের খোঁপে।

নাগরিক জীবনে নানা ব্যস্ততা কাটিয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই মানুষ ঘুরতে বেরোয়। কেউ ছোটে সমুদ্রে, কারও পছন্দ পাহাড়, আবার কেউ ছোটে হাওরের দিকে। অনেকেই ছুটি পেলে ছুটে যান তার প্রিয় গ্রামটিতে। কাকডাকা ভোর, শালিক আর টুনটুনির ডাকে বিমোহিত হওয়া, বিস্তীর্ণ সবুজ ধানক্ষেতের বুকে ভারী বাতাসের ঢেউ ঢেউ খেলা— এসবই তাকে আন্দোলিত করে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদী মনকে আনমনা করে দেয়। হৃদয়ে জমে থাকা স্মৃতিগুলোও ঝড় তোলে। এ সবই ভ্রমণপ্রেমীদের ভালোলাগার অংশ হয়ে ওঠে।

দেশে ভ্রমণপিপাসু মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এখন গড়ে উঠেছে ছোট ছোট অ্যাডভেঞ্চার গ্রুপও। অজানা সব স্থান খুঁজে সেখানকার অপরূপ দৃশ্য অবগাহন করে তৃপ্ত হয় তারা। তাদের মাধ্যমে ভ্রমণের নতুন নতুন জায়গার খোঁজও পাই আমরা।

ডিজিটাল এ যুগে ভ্রমণপাগল এই মানুষদের নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য গ্রুপ, পেইজ ও হেল্পলাইন। সেখানে ভ্রমণের নানা ইভেন্টগুলোতেও অংশ নিচ্ছে অসংখ্য ভ্রমণপিপাসুরা, যা বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনাকেই স্পষ্ট করে।

ভ্রমণের মনছোঁয়া অনুভূতিগুলো ছবিসহ মানুষ এখন প্রকাশ করছে ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটারসহ সোশ্যাল মিডিয়ায়। ভ্রমণ নিয়ে ইউটিউব চ্যানেলও খুলে বসেছে অনেকেই। ফলে ভ্রমণে আগ্রহীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি দ্রুত প্রচার পাচ্ছে দেশের নতুন নতুন স্থানগুলোও।

দেশের ভেতর ঘুরতে বা বেড়াতে কোথায় এবং কীভাবে যাওয়া যায়, কোন সময় যেতে হয়, থাকার জায়গা কেমন ও কোথায়, খাবারের ব্যবস্থা কেমন, নিরাপত্তাজনিত সমস্যা আছে কিনা, থাকলে সমাধানে কোথায় যোগাযোগ করতে হবে, ভ্রমণ কতটা ব্যয়বহুল— এসব প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজতে সবাই গুগল ও ফেইসবুকে ভ্রমণ গ্রুপগুলোর সহযোগিতা নেয়। ইউটিউবে ওই জায়গার ভিডিও কেউ আপ করে থাকলে সেটিও বিবেচনার অংশ হয়। অথচ এ যুগে ভ্রমণের এ তথ্যের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটফর্ম হওয়ার কথা পর্যটন মন্ত্রণালয় বা তাদের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও পর্যটন করপোরেশন। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি হয়নি।

সাধারণের কাছে পর্যটনসেবা হিসেবে নানা স্থানে ভ্রমণের তথ্যগুলো উপস্থাপনে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রচারণা কার্যক্রমও খুব একটা নজরে আসে না। পাশাপাশি এদের ওয়েব পোর্টালগুলোতেও নেই হালনাগাদ তথ্য। ফেইসবুক পেইজ, টুইটার ও ইউটিউব চ্যানেল থাকলেও তা চলছে দায়সারাভাবে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বলছে সারা দেশে প্রায় সাড়ে ৪০০ প্রত্ন স্থান রয়েছে। এ প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনাগুলো দেশে ও বিদেশে পরিচিত করতে পারলে পর্যটনের নতুন গন্তব্য তৈরি হতে পারে বাংলাদেশে। কিন্তু সেটি করার দায়িত্ব আসলে কে নেবে?

আবার সরকার নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্ব দিলেও পর্যটনশিল্প এখনো নারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। নারী এখন সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পুরুষের মতো তারাও বেরিয়ে পড়তে চায় তাদের পছন্দের জায়গায়। ভ্রমণে নারীদের নানা গ্রুপও তৈরি হয়েছে এখন। কিন্তু শুধু নারীদের হোটেল ভাড়া দেওয়া এবং নিজের মতো তাদের ভ্রমণের নিরাপত্তা কি আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি? উত্তরটি অবশ্যই ‘না’।

পর্যটন এলাকাগুলোকে আরও বেশি নারীবান্ধব করতে পৃথক ও পরিচ্ছন্ন বিশ্রামাগার এবং নিরাপত্তার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অধিকসংখ্যক নারী কর্মীদের নিয়োজিত করাও যেতে পারে। পর্যটন এলাকায় নারীর অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করতে পারলে বিদেশি নারী পর্যটকরাও বাংলাদেশে আসতে আগ্রহী হবে। এটি সার্বিক অর্থনীতি ও বিনিয়োগ আকর্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের মানসিকতার যেমন পরিবর্তন ঘটানো প্রয়োজন, তেমনি সরকারেরও বিশেষ পরিকল্পনা ও উদ্যোগ হাতে নিতে হবে।

আবার আমরা আনন্দ নিয়েই ভ্রমণ করি। কিন্তু ভ্রমণে পরিবেশ রক্ষায় কতটা সচেতন থাকছি? গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে সেটিও খানিকটা তুলে ধরছি।

সেন্ট মার্টিন আমাদের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। এর চারদিকে রয়েছে প্রবাল, পাথর, ঝিনুক, শামুকের খোলস, চুনা পাথরসহ প্রায় কয়েকশ প্রজাতির সামুদ্রিক জীব। এখানকার প্রবাল ও শৈবালের জন্য প্রয়োজন বিশেষ পরিবেশের। কিন্তু সেটি কোনোভাবেই হচ্ছে না পর্যটকদের অসচেতনতা ও অপরিকল্পিত পর্যটন ব্যবস্থার কারণে।

ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি পর্যটক প্রতিদিন পা ফেলে এই দ্বীপে। বিশেষ করে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পর্যটকদের এ চাপ থাকে প্রবল। হাজার হাজার পর্যটক ভ্রমণকালে শুকনো খাবার হিসেবে প্লাস্টিক মোড়কজাত চিপস বা বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্য বহন করেন। সঙ্গে থাকে মিনারেল ওয়াটার, জুস, কোল্ডড্রিংসসহ বিভিন্ন দ্রব্যাদি। খাওয়ার পর যত্রতত্র তা ছুঁড়ে ফেলেন তারা। ওই বর্জ্যেই দূষিত হচ্ছে দ্বীপের পরিবেশ, যা প্রতিনিয়ত সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অস্তিত্বকে ঝুঁকিতে ফেলছে।

দূষণ থেকে রক্ষা পায়নি পাহাড়ও। এ সময়ের জনপ্রিয় পর্যটন স্পট সাজেক। সেখানেও বাড়ছে পর্যটকদের উপস্থিতি। একইসঙ্গে বাড়ছে ময়লার স্তূপ। সাজেক যাওয়ার পথসহ পর্যটকরা যেখানে-সেখানে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন ফেলেন। এতে প্রত্যেকটি কটেজ, পাহাড়ের দুদিকে ময়লা-আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে। যার অধিকাংশই পচনযোগ্য নয়। ফলে ক্রমেই সৌন্দর্য হারাচ্ছে সাজেক।

একই সমস্যার মুখে পড়েছে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র চট্টগ্রামের হাটহাজারীর হালদা নদী। হালদায় ১২ কিলোমিটার ধরে ব্লক বসানো ও বাঁধ নির্মাণের ফলে প্রতিদিন সেখানে ভিড় করছেন হাজারও পর্যটক। নদীর রূপ দেখতে আসা এসব পর্যটক প্রতিদিন হালদায় ফেলছেন প্লাস্টিকের প্যাকেট, পলিথিন, প্লেট, পানির বোতল, চিপসসহ নানা প্লাস্টিকের আবর্জনা। এভাবে পর্যটকদের ফেলা প্লাস্টিক ও পলিথিনে দূষিত হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, টেকনাফ, খুলনার সুন্দরবন, নেত্রকোনার বিরিশিরি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানসহ পর্যটন স্থানগুলো।

উল্লিখিত স্থানগুলোতে পর্যটক হিসেবে যারা বেড়াতে বা ভ্রমণে যান, তারা অধিকাংশই সমাজের শিক্ষিত ও সচেতন শ্রেণির মানুষ। সামর্থ্যের দিক থেকেও তারা এগিয়ে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে নিজের বাড়িটিকে পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি করে রাখতেই তারা পছন্দ করেন। ওই হিসেবে আশা করা যায় যে, তারা রুচিশীল। কিন্তু ভ্রমণে গিয়ে চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে কেন তারা সেই রুচিশীল আচরণটি ধরে রাখতে পারেন না— সেটি ভেবেই অবাক হতে হয়। তাই পরিবেশবান্ধব সচেতন পর্যটক হিসেবে নিজেকে পরিবর্তনের দায়িত্ব নিতে হবে প্রত্যেককেই।

পাশাপাশি সমুদ্র ও নদীর জীববৈচিত্র্য কী? সমুদ্রের সঙ্গে আমাদের আচরণ কী হওয়া উচিত? সমুদ্রে ও নদীতে প্লাস্টিক, পলিথিন ফেললে সুদূরপ্রসারী কী কী ক্ষতি হতে পারে? পার্বত্য অঞ্চলকে কেন ও কীভাবে দূষণমুক্ত রাখতে হবে? এই বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগেরও প্রবল ঘাটতি রয়েছে। সরকার কঠোর হলেই পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে মনে করেন অনেকেইে। এ ক্ষেত্রে মানুষকে পরিবেশসচেতন করতে উদ্যোগী হতে পারে গণমাধ্যমও। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভ্রমণবিষয়ক গ্রুপগুলোও সচেতন ও পরিবেশবান্ধব পর্যটক তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

ছুটির অবসর পেলেই ভ্রমণপাগল লাখো মানুষ ছোটেন পাহাড়, সমুদ্র ও নদীর আলিঙ্গন পেতে। কিন্তু সেখানে পর্যটকদের আনন্দ উপভোগে বাধা হয়ে দাঁড়ায় হোটেল ও মোটেলের অব্যবস্থাপনা ও স্বেচ্ছাচারিতা। হোটেল, রিসোর্ট বা গেস্ট হাউসগুলোর ভাড়া কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়, রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে পণ্যের ও খাবারের দোকান এবং যানবাহনের চালকরাও অতিরিক্ত অর্থ আদায়ে মেতে উঠে সবাই। ফলে পর্যটকদের গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা। এছাড়া পর্যটকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার অভিযোগও উঠে আসে গণমাধ্যমে। এভাবে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা করলেও পর্যটনশিল্পে এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন অনেকেই।

পাশাপাশি পর্যটন এলাকাগুলোতে খাবারসহ হোটেল ও মোটেলের ভাড়া কেন সরকারকর্তৃক নিয়ন্ত্রিত নয়, পর্যটকরা কেন স্বাভাবিক সেবা থেকে বঞ্চিত হন? এসব অভিযোগ দেখার জন্য কোন কর্তৃপক্ষ দায়িত্বে আছেন? এমন নানা প্রশ্নও উঠে আসে পর্যটকদের মনে।

বাংলাদেশে সুন্দরবন, কুয়াকাটা, সেন্ট মার্টিন, পতেঙ্গা, কক্সবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ ইত্যাদি ভ্রমণপিপাসুদের জন্য প্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হলেও ওইসব জায়গার যোগাযোগ, নিরাপত্তা, খাবার-দাবার নিয়ে পর্যটকদের নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এসব সমস্যার সমাধান না করলে দেশের পর্যটন কোনোভাবেই এগোবে না।

প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর হাওর-বাঁওড়-নদীবেষ্টিত জেলা কিশোরগঞ্জ। প্রতিদিন হাজারও মানুষের পদভারে মুখর থাকে হাওরাঞ্চল। শুষ্ক মৌসুমে মাইলের পর মাইল ফসলি জমি, ধূলিওড়া মেঠোপথও আকর্ষণ করে পর্যটকদের। কিন্তু এ এলাকায় পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা এখনও গড়ে ওঠেনি। ফলে ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের আবাসন, খাওয়া-দাওয়াসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতেই হয়। হাওরে পর্যটকদের জন্য রাত্রিযাপন, খাওয়া-দাওয়া এবং আনন্দ বিনোদনের সুব্যবস্থা রাখা জরুরি। সেটি করতে হবে পরিবেশ সুরক্ষার দিকটি মাথায় রেখেই। এছাড়া সেখানে নৌকার মাঝিদের সিন্ডিকেট ও অতিরিক্ত নৌকাভাড়া নেওয়ার কারণেও পর্যটক কমছে বলে মনে করেন অনেকেই।

বর্ষা মৌসুমে প্রায় শতাধিক হাউজবোট নেমেছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধরমপাশা উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরে। যার মালিকানা প্রায় দুই শতাধিক তরুণের। এটিকে ‘ঠিকমতো ব্র্যান্ডিং’ করা গেলে হাওর পর্যটনে বাইরের পর্যটকও পাওয়া যাবে। তাই যেসব তরুণ হাওর পর্যটনে এগিয়ে এসেছেন, তাদের সহজশর্তে ঋণসহ সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা করার উদ্যোগ নেওয়াও প্রয়োজন।

আবার সবুজে ঘেরা টিলা আর চমৎকার সব রিসোর্ট রয়েছে চায়ের রাজধানী খ্যাত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে। একদিকে হাওর, অন্যদিকে চা-বাগান নিয়ে এখানে পর্যটনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকলেও সেখানে পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন কমছে বলে মনে করেন পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। আর পর্যটকদের ভাষ্য, ট্রেনের পর্যাপ্ত টিকিট না থাকা, ভাঙা রাস্তা, চিত্তবিনোদনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা, সেবার তুলনায় হোটেল-রিসোর্টে বেশি খরচের কারণে পর্যটকরা সেখানে যেতে চান না।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনার কথা আমরা প্রায়শই শুনি। কিন্তু পাহাড়ে কোন ধরনের পর্যটন সম্ভাবনাকে টেকসই ও লাগসইভাবে কাজে লাগানো যাবে ওই সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ও পরিকল্পনা নেই সংশ্লিষ্টদের। সেখানে পর্যটন উন্নয়নের নামে যা হচ্ছে, তার অধিকাংশই অপরিকল্পিত বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। ফলে এই পর্যটন নিয়ে পাহাড়ের বাসিন্দাদের মনে বিরূপ ধারণাও তৈরি হয়েছে। পর্যটন মানে পাহাড়ে বহিরাগত লোকজনের ভূমিদখল ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলে মনে করে তারা। পর্যটনবিশেষজ্ঞদের মতে, নেতিবাচক এই ধারণা কমিউনিটি ট্যুরিজম (সামাজিক পর্যটন) ও ইকো-ট্যুরিজমের (প্রতিবেশ পর্যটন) মাধ্যমে দূর করা যেতে পারে। এ নিয়ে সচেতনতা ও সমন্বিত উদ্যোগেরও প্রয়োজন রয়েছে।

বাগেরহাটের দক্ষিণে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর। দীর্ঘদিন পর্যটকবান্ধব প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা গড়ে না ওঠায় বাগেরহাটের পর্যটনখাত এখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। জেলাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পুরাকীর্তি ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। আছে মাছ, চিংড়ি, সবজিসহ কৃষিপণ্যের প্রাচুর্য। আরও রয়েছে জেলে, মৌয়াল, কৃষক ও কারুশিল্পীদের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। পর্যটন বিকাশের এমন অনুষঙ্গ থাকলেও পিছিয়ে আছে সম্ভাবনাময় এ জেলাটি।

স্থানীয়রা মনে করেন দর্শনার্থীদের কাছে স্থানগুলোর গুরুত্ব ও সৌন্দর্য সঠিকভাবে তুলে ধরতে না পারা, সরকারি পর্যায় থেকে ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে সমন্বয় ও অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত না হওয়ার কারণেই এ অঞ্চলের পর্যটনশিল্পের বিকাশ সেভাবে ঘটছে না। এ জন্য প্রয়োজন সমন্বিত ও কার্যকর কর্মপরিকল্পনা।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের শেষ ও বঙ্গোপসাগর তীরের জেলা বরগুনার মতো প্রকৃতির বাহারি সৌন্দর্যের সমাহার খুব কম জায়গায়ই মেলে। শুভসন্ধ্যা সমুদ্রসৈকত, টেংরাগিরি বনাঞ্চল, হরিণঘাটা বনাঞ্চল, মোহনা পর্যটনকেন্দ্রসহ জেলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে প্রকৃতির সৌন্দর্য।

পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ঘিরে দেশের পর্যটনশিল্পের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অভাবে তার বিকাশ ঘটছে না।

বিশিষ্টজনদের অভিমত, বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারলে দেশের অর্থনীতিও চাঙ্গা হবে। পর্যটন শিল্পের প্রসার করতে টেলিভিশন, বেতার এবং ডিজিটাল মাধ্যমে পর্যটনকেন্দ্র সম্পর্কে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে হবে।

সরকারিভাবে একটি ‘ট্যুর ইনফরমেশন সেন্টার’ চালু করা যেতে পারে, যেখান থেকে পর্যটকরা সহজে সব তথ্য পাবেন। এ ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তবে অধিক মুনাফা নয়, পর্যটকদের মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিতের মাধ্যমেই পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানো সম্ভব বলে মনে করেন সকলেই। তবে সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিতে হবে সরকারসহ সকলকেই।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ০২ডিসেম্বর ২০২৪

© 2024, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button