কালিহাতির ইছাপুরা অপারেশন
“একাত্তরে দেশের জন্য তিন–চারদিন না খেয়েও ছিলাম। নয় মাস পায়ে জুতা পরি নাই। এর মধ্যে নামাজও পড়েছি।”
মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল হাকিম, বীরপ্রতীক। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ১৯৬২ সালে, সিপাহি হিসেবে। তার বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলার মেদুর গ্রামে। একাত্তরে তিনি ছিলেন সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে, গাজীপুরে।
একাত্তরের কথা তিনি বলেন যেভাবে- আমাদের কাছে তখন অনেক অস্ত্র ছিল। কেননা গাজীপুরে সমরাস্ত্র কারখানায় আধুনিক চায়নিজ রাইফেল তৈরি হতো। একাত্তরে বাঙালি সেনাদের প্রতিরোধ ঠেকাতে ১৫ মার্চের মধ্যে তাদের অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু অস্ত্র জমা পড়ে না। ১৯ মার্চ ঢাকা থেকে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত একটি সেনাদল নিয়ে জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে আসেন পাঞ্জাবি ব্রিগেড কমান্ডার জাহান জেব।
এদিকে জয়দেবপুরে সাধারণ মানুষ ও নেতাদের সঙ্গে আগেই যোগাযোগ হয় সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। ফলে তাদের নিরস্ত্র করার খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতারা স্থানীয় জনসাধারণকে নিয়ে তখন পথে নামেন। ওইদিন ছিল হাটবার। হাজার হাজার মানুষ দেশি বন্দুক, রামদা, বটিসহ যার কাছে যা ছিল তা নিয়েই জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টের কাছের রেলগেইটের সামনে ব্যারিকেড দেয়।
এ অবস্থা দেখে জাহান জেব কৌশল আঁটেন। ঘটনাস্থলে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গলের বাঙালি সেনাদের ঢাল হিসেবে সামনে দিয়ে পেছনে তিনি অবস্থান নেন এবং গুলির নির্দেশ দেন। কিন্তু বাঙালি সেনারাও কৌশলে জনতার দিকে অধিকাংশই ব্ল্যাংক ফায়ার (ফাঁকা গুলি) করে। ফলে হতাহত কম হয়। তারপর আধঘণ্টার মধ্যেই সব ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলা হয়।
এ অবস্থা দেখে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার পরিকল্পনা ত্যাগ করে জাহান জেবের বাহিনী ঢাকার দিকে ফিরতি পথ ধরে। কিন্তু পথেই চন্দনা চৌরাস্তাতে তারা জনতার ব্যারিকেডের ভেতর পড়ে যায়। সেটি অপসারণ করতে গেলে হুরমত নামে এক খ্যাতিমান ফুটবলার এক পাঞ্জাবি সেনার রাইফেল কেড়ে নেয়। অন্য পাকিস্তানি সেনারা তখন তার মাথায় গুলি করে। হুরমত ওখানেই শহীদ হন। তার স্মৃতির উদ্দেশে ওই জায়গায় এখনও জাগ্রত চৌরঙ্গী স্মৃতিস্তম্ভটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
তারপর কী ঘটল? সে ইতিহাস শুনি জয়দেবপুর ব্যারাকে থাকা আবদুল হাকিমের মুখেই। তার ভাষায়, ২৬ মার্চ ১৯৭১। ব্যারাকে ছিল ৭০ জন অবাঙালি পাঞ্জাবি ও পাঠান সেনা। ওদের কী করা হয়েছে সেটা ছিল আর্মির গোপন বিষয়। আমার ছেলের বয়স তখন দশ মাস। স্ত্রী ও সন্তানকে রেখেই সফিউল্লাহ সাহেবের স্কোয়াডের সঙ্গে বেরিয়ে চলে যাই ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে। পরে নরসিংদী হয়ে ভৈরবে বিশ্ব গোডাউনে পজিশন নিই।
এক ব্যাটেলিয়নে প্রায় ৭৯৯ জন ছিলাম। সেখানে আমাদের পজিশন ছিল নদীর ধারে। ৪টা পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান বোম্বিং করেও কিছু করতে পারেনি। কারণ খুব পোক্তভাবে ওই গোডাউনটি তৈরি করেছিল জাপানিরা। পাকিস্তানিরা তখন হেলিকপ্টারে করে আমাদের ঠিক পেছনে সেনাদের নামিয়ে দেয়। শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি।
ওই যুদ্ধেই সুবেদার সিরাজুল ইসলাম শহীদ ও নাসিম সাহেব আহত হন। পরে আমি ছুটি নিয়ে বাড়িতে চলে আসি। তারপর কাদেরিয়া বাহিনীতে যুক্ত হয়ে কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব পাই। ‘হাকিম কোম্পানি’ নামেই সবাই চিনত। অপারেশন করেছি দেওপাড়া, ধলাপাড়া, সরাবাড়ি ও সাগরদীঘি প্রভৃতি এলাকায়। পাঞ্জাবিরা যেদিকে যাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। এটাই ছিল কাদেরিয়া বাহিনীর নির্দেশ। অ্যাম্বুশ করে ওদেরকে ঘায়েল করতাম আমরা।
রণাঙ্গনের একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশনের কথা শুনি বীরপ্রতীক আবদুল হাকিমের মুখে। অকপটে তিনি বলেন, স্বাধীনতা লাভের কয়েকদিন আগের ঘটনা। আমরা তখন মোগলপাড়া স্কুলে। খবর আসে টাঙ্গাইল থেকে পাঞ্জাবিরা ময়মনসিংহের দিকে যাবে। ইছাপুরায় ওদের ঠেকাতে হবে। রাত তখন চারটা হবে। মোগলপাড়া থেকে রওনা হয়ে দ্রুত ইছাপুরায় গোরস্তানে এসে পৌঁছি। সঙ্গে ছিল থ্রি-ইঞ্চ মর্টার। যার একটা অংশ ৭৫ পাউন্ড, একটা ৬৫ পাউন্ড ও আরেকটা ৪৫ পাউন্ড। অন্যান্য আর্মস ও অ্যামুনেশনও ছিল।
গোরস্থানের উত্তর পাশে ছিল একটা কাঁঠাল গাছ। ওখানেই থ্রি-ইঞ্চ মর্টার সেট করি। ১৯৫০ গজ হলো ওই মর্টারের রেঞ্জ। যেই দিকেই দিই, ওটা ওই রেঞ্জে গিয়েই পড়বে। আর ওদের ট্রাকের গতির কোনো হিসাব জানা ছিল না। মর্টার সেট করার সঙ্গে সঙ্গে দেখি পাকা রাস্তা দিয়ে পাঞ্জাবি বোঝাই কয়েকটা ট্রাক আসছে। তখন মজনুকে বললাম, একটা বোমা ফায়ার কর। বোমা ওদের চলন্ত ট্রাকের ওপর গিয়ে পড়ে। ফলে ট্রাকটা উল্টে যায়। পেছনে থাকা ট্রাকও থেমে যায়। আমরা ক্রমাগত বোমা ও গুলি করতে থাকি। চারদিকে আগুন আর আগুন। ফলে ভয়ে পাঞ্জাবিরা আর অগ্রসর হতে পারে না।
পরে পেছন দিক থেকে গাড়ি নিয়ে আসে ভারতীয় বিগ্রেডিয়ার সন্দ সিং বাবাজি। তিনি এসে আমাদের থ্রি-ইঞ্চ মর্টারটি দেখলেন। মর্টারের টেলিস্কোপ সাইড নেই, ডিগ্রি উঠানামারও কোনো কিছুই নেই। শুধু একটা ট্রাইপড আছে। এ অবস্থায় কীভাবে ফায়ার করা সম্ভব! তিনি অবাক হলেন। আমাকে ডেকে বললেন, “হাউ হ্যাভ ইউ ফায়ার।” আমি বলি, “ওপিজি গড।” মানে, আল্লাহ নিজেই অবজারবেশন পোস্টে কাজ করেছেন। শুনে তিনি পিঠ চাপড়ে বললেন, “সাব্বাশ বাঙালি।” তার এই কথাটা এখনও কানে বাজে।
দেশটা ভালো চললে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হন মুক্তিযোদ্ধারা। এমনটাই মনে করেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাকিম। স্বাধীন দেশ নিয়ে কষ্টের কথাও অকপটে বলেন এভাবে, “যেখানেই যাই স্বার্থ। স্বার্থ ছাড়া কেউ কিছু করে না এখন। এমনটা তো চাইনি।”
কী করলে দেশ আরও এগোবে? তিনি বলেন, “মানুষের মধ্যে সৎ কর্ম, সৎ সাহস, সৎ চিন্তা, সৎ ইচ্ছা, ন্যায়পরায়ণতা ও অল্প সন্তুষ্টি– এগুলো যদি থাকে তাহলেই দেশ এগোবে। কম খাই, কিন্তু যেন হারাম নামের কোনো জিনিস না খাই। যদি মানুষ সত্যের দিকে ধাবিত হয়, সত্যকে যদি আকড়ায়া থাকে, তাহলেই দেশ এগোবে।”
প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে এই বীরপ্রতীক বলেন, “একাত্তরে দেশের জন্য তিন-চারদিন না খেয়েও ছিলাম। নয় মাস পায়ে জুতা পরি নাই। এর মধ্যে নামাজও পড়েছি। তাদের তো জানাতে হবে মুক্তিযোদ্ধারা কতটুকু কষ্ট কইরা তাদের জন্য এই দেশ স্বাধীন করছে। এটা না জানলে তারাও দেশের জন্য ত্যাগী হতে পারবে না।”
বাংলাদেশের মানুষ ‘অনেক জ্ঞানী’ বলে মনে করেন এই সূর্যসন্তান। এ কারণেই যেকোনো দেশেই আমাদের সন্তানদের ওরা নাগরিক করে রেখে দেয়। তাই প্রজন্মকে নিয়ে পাহাড়সম আশা যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাকিম বীরপ্রতীকের। তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন শেষ কথাগুলো, ঠিক এভাবে, “যদি সৎ নিয়ত, অল্প সন্তুষ্টি আর সততা থাকে, তাহলে দেশের উন্নতি হবে। তোমরা সে পথেই থেকো। অনুরোধ রইল, তোমরা সোনার বাংলাকে ছেড়ে যেও না। এই দেশটাকে ভালো রেখো। তোমাদের প্রতি দোয়া থাকবে সবসময়।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪
© 2024, https:.