মুসলিম হয়েও পাকিস্তানিরা মুসলিমদেরই হত্যা করেছিল
এই স্বাধীন দেশের মাটির সঙ্গে মিশে আছে আমার বাবার রক্ত। ফলে এটা আমার কাছে অন্যরকম এক দেশ। কিন্তু শহীদ হিসেবে এই স্বাধীন দেশের ইতিহাসে নেই তার নাম।
“একাত্তরের জুলাই মাসের ঘটনা। বড় একটা অপারেশন হয় আলমডাঙ্গা ওয়াপদা অফিসের উত্তর দিকে। খবর পাই একটা সামরিক ট্রেন আসবে যশোর থেকে। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। কমান্ডার আব্দুল হান্নান সবাইকে নিয়ে বসেন। তার নেতৃত্বেই তখন রেললাইনে অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন ফিট করার পরিকল্পনা হয়।
রাতের দিকে সবাই রেললাইনে জড়ো হই। অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন ফিট করা হবে। হান্নান ভাই দু-জনকে তার সঙ্গে রেখে আমিসহ বাকিদের দ্রুত সরে যেতে বলেন। আমরা তাই করি। রাতে ওই সামরিক ট্রেনটা এলেই বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে। পাকিস্তানি আর্মির অনেক সদস্য মারা যায় সেখানে।
বিস্ফোরণটা খুব কাছ থেকে ঘটানো হয়েছিল। ফলে হান্নান ভাইদেরও বেঁচে আসার কথা নয়। বহুকষ্টে তারা সরে আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেখানে তিনি পরনের শার্টটি রেখে আসেন। ওই শার্টের পকেটে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটা তালিকা। আলমডাঙ্গা থানা থেকে ভারতে প্রশিক্ষণে যাওয়া প্রায় একশ মুক্তিযোদ্ধার নাম ছিল ওই তালিকায়।
ওই অপারেশনের পর পাকিস্তানি আর্মি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। পরদিন তারা আসে ঘটনাস্থলে। নানা আলামত খুঁজতে গিয়ে ওই শার্টটা এবং পকেটে থাকা তালিকাটি পায় তারা। পরে ওই তালিকা ধরেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনেকের বাবা, মা ও পরিবারের লোকজনকে তুলে আনে। তথ্য জানতে নানাভাবে টর্চারও করে তারা।
ওয়াপদা অফিসের ভেতরে ছিল পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্প। ওরা আমার বাড়িতে গিয়ে আব্বাকেও তুলে নিয়ে যায়। নির্মম টর্চার চলে তার ওপর। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে অনেককে ছেড়ে দিলেও বাবাকে ওরা ছাড়েনি।
আমার নানা তথ্য জেনে যায় ওরা। স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম, মিছিল করেছি, সংগ্রাম পরিষদে কাজ করেছি, আলমডাঙ্গায় বিহারিদের আটকে রেখেছিলাম— এমন খবরগুলো ছিল তাদের কাছে। ফলে আমাকে ধরতে ওরা মরিয়া হয়ে ওঠে।
এ কারণে আব্বার ওপরও টর্চার করেছে বেশি। পরে সাত দিনের সময় বেধে দিয়ে আর্মিরা বাড়িতে খবর পাঠায়। এর মধ্যে ওদের কাছে আমি সারেন্ডার করলেই আব্বাকে ছাড়া হবে, দেয় এমন শর্ত। টর্চার মেনে নিলেও আব্বা চাননি ছেলে ধরা দিক। আম্মা ও বড় বোন খাবার নিয়ে দেখা করতে গেলে কোনোক্রমেই আমি যেন ধরা না দেই সেই নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।
ওরা ৮-১০ দিন রেখেছিল আব্বাকে। প্রতিদিনই টর্চার করত। বুটের লাথি আর মারের চোটে শেষে খাওয়া-দাওয়াও বন্ধ হয়ে যায় তার। আমি সারেন্ডার না করায় পাকিস্তানি আর্মিরা তাকে আলমডাঙ্গা রেলব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ওখানে অনেককেই এভাবে হত্যা করা হয়েছিল। সবার ডেডবডি একত্রে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। স্বাধীনতার পর অনেক মানুষের হাড়গোড় উদ্ধার হয় ওখান থেকে। কিন্তু আব্বাসহ কাউকেই আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়নি।
আমার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অপরাধেই আব্বাকে ওরা হত্যা করেছে— এটা মনে হলেই বুকের ভেতরটা খামছে ধরে। একাত্তরে এভাবে নিরীহ বহু মানুষকেই হত্যা করেছিল পাকিস্তানি আর্মি। মুসলিম হয়েও পাকিস্তানিরা মুসলিমদেরই হত্যা করেছিল। এই স্বাধীন দেশের মাটির সঙ্গে মিশে আছে আমার বাবার রক্ত। ফলে এই দেশটা আমার কাছে অন্যরকম দেশ। কিন্তু শহীদ হিসেবে এই স্বাধীন দেশের ইতিহাসে নেই তার নাম। কারণ রাষ্ট্র এখনও শহীদদের কোনো তালিকা করেনি! ফলে আমরা এখনও কৃতজ্ঞ জাতি হয়েছি— এটা মনে করতে পারি না।”
একাত্তরে বাবা জিন্নাত আলী খান শহীদ হওয়ার ঘটনাটি এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. রমজান আলী খান। এক দুপুরে চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলা সদরে তার বাড়িতে বসেই আলাপ চলে যুদ্ধদিনের অজানা সব ঘটনা প্রসঙ্গে।
রমজান আলীর ডাক নাম বাচ্চু। মায়ের নাম রওশান আরা বেগম। দুই ভাই ও এক বোনের সংসারে তিনি দ্বিতীয় সন্তান। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে গ্রামের বাড়িতেই। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি আলমডাঙ্গা গোবিন্দপুর প্রাইমারি স্কুলে। পরে ভর্তি হন আলমডাঙ্গা হাই স্কুলে (তখন নাম ছিল আলমডাঙ্গা মাল্টিলিটারেল হাই স্কুল)। মুক্তিযুদ্ধের সময় রমজান ছিলেন ওই স্কুলেরই এসএসসি পরীক্ষার্থী।
আলাপচারিতায় ফিরে আসি একাত্তরে। ২৫ মার্চের পরে রমজান আলী কী করলেন আলমডাঙ্গায়?
তার ভাষায়, “সারাদেশে আর্মি নেমেছে। খবরটা শুনেই মাথায় ঘুরছিল কীভাবে একটা অস্ত্র পাই। কয়েকজন মিলে আলমডাঙ্গা থানায় গিয়ে কাউকেই পেলাম না। অস্ত্রাগারের তালা ভেঙ্গে দুটি রাইফেল আর গুলি নিই পকেট ভরে। রাইফেল দুটি সবসময় আমার কাছেই থাকত।
অনেক বিহারি ছিল আলমডাঙ্গায়। গ্রামের সবাই মিলে একটা মিটিং করে। বিহারিদের নিরাপদে রাখলে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি আর্মি আলমডাঙ্গায় এলেও অত্যাচারটা তেমন করবে না। গণমান্য সবাই মিলেই তাদের নিরাপদে রাখার সিদ্ধান্তটা নেয়। পরিবারসহ সকল বিহারিকে আলমডাঙ্গায় একটা বড় তেলের মেইলে নিরাপদে রাখি আমরা। কেউ যেন আক্রমণ করতে না পারে তাই বাহিরে রাইফেল নিয়ে পাহারায় ছিলাম আমি। কিন্তু বিহারিরা অনেকেই ভেবেছিল আমরা তাদের আটকে রেখেছি। এটাই পরে তারা পাকিস্তানি আর্মিকে বলে দেয়।
এপ্রিল মাসের প্রথমদিকের ঘটনা। যশোর থেকে দুটি ফাইটার প্লেন দুপুরের দিকে চুয়াডাঙ্গায় বোম্বিং করে। আলমডাঙ্গা থেকেই দেখা যাচ্ছিল ওখানে ধোয়া উড়ছে। সহ্য করতে পারলাম না। সাথে রাইফেল আছে। ভাবলাম কিছু একটা করব। ফাইটারটা খুব নিচু দিয়েই যাচ্ছিল। আলমডাঙ্গা অতিক্রম করার সময় একটা বড় দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে আমি ফাইটার বরারব ৫ রাউন্ড গুলি করি। গুলি লাগল কিনা জানি না। কিন্তু এই ঘটনায় বেশ তৃপ্ত হয়েছিলাম।
বিহারিদের চোখের সামনেই ঘটে ঘটনাটি। আমার কাণ্ড দেখে ওরাও ভয় পেয়ে যায়। এ খবরটা চলে যায় শান্তি কমিটির লোকদের কাছে। আলমডাঙ্গায় শান্তি কমিটিতে ছিল আনিস খান, ইউসুফ মিয়া, মফিজ উদ্দিন বিশ্বাস, আহমেদ আলী প্রমুখ। ওইদিন বিকেলে তারা আমাকে ডেকে বলেন, ‘কাজটা তো তুমি খারাপ করেছ বাচ্চু।’ এরপর থেকে আমাকে তারা চোখে চোখে রাখত। পরে তো গোপনে ট্রেনিংয়ে চলে গেলাম।”
ট্রেনিংয়ে গেলেন কোন সময়টায়?
তিনি বললেন যেভাবে, “এপ্রিলের ১৮ তারিখের দিকে কথা। হান্নান ভাই, নান্নু ভাই, আশরাফুদ্দিন আসু, রশিদ ভাই, ফরহাদ ভাই, সবেদ আলী, নূর মোহাম্মদ, ইমদাদুলসহ এলাকার ১৪-১৫ জন একত্রে পরিকল্পনা করি। পরে বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়েই ঘর ছাড়ি। বিকেলের দিকে রওনা হই আমরা। মেহেরপুর বর্ডার পার হয়ে ঢুকি ভারতে। ওখান থেকে কেউ গেল করিমপুর, কেউ আবার কলকাতায়। আমরা থাকি বেতাই নামক জায়গায়। তখন মাত্র ক্যাম্পের মতো করা হচ্ছিল। পরে উচ্চতর গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের পাঠানো হয় বিহারের সিংভুম জেলার চাকুলিয়া সাবডিভিশনে। ব্রিটিশ আমলের একটা পরিত্যক্ত ক্যান্টনমেন্ট ছিল ওখানে, নাম চাকুলিয়া। সেখানে ৪২ দিন ট্রেনিং করায় ভারতীয় সেনাবাহিনী। থ্রি নট থ্রি, মার্ক ফোর রাইফেল, এসএলআর, এসএমজি, ব্যাটাগান, স্টেনগান, লাইট মেশিন গান, টুইঞ্চ মর্টার প্রভৃতি চালানো শেখায় তারা। চাকুলিয়ায় আমরাই ছিলাম প্রথম ব্যাচ। তিন নম্বর উইংয়ে ট্রেনিং করি, আমার এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ছিল ২০১।”
ট্রেনিং শেষে রমজানদের পাঠানো হয় সীমান্তবর্তী এলাকা হৃদয়পুরে। তারা ছাড়াও সেখানে অনেকগুলো দল ছিল। পরে তাদের গ্রুপ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কৃষ্ণনগরে। ওখান থেকেই অপারেশনগুলো পরিচালিত হতো। জায়গাটির নাম শক্তিনগর। হর্টিকালচারের একটা বাগান ছিল। ওই বাগানেই ক্যাম্প করে রমজানরা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডেই অপারেশন করতেন তখন। ভেতরে ঢুকে আক্রমণ করেই আবার ফিরে আসতেন। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট ছোট টিমে ভাগ করা হয়। প্রথম দিকে রমজান কুষ্টিয়া হরিপুরের হাদীর গ্রুপে থাকলেও পরে চলে যান আলমডাঙ্গার আব্দুল হান্নানের গ্রুপে। আট নম্বর সেক্টরের অধীন তারা অপারেশন করেন প্রথমদিকে বৃহত্তর কুষ্টিয়ার বিভিন্ন জায়গায় এবং পরে আলমডাঙ্গায়।
প্রথম যে অপারেশনটি হয় আলমডাঙ্গায় সেটি এখনও রমজান আলীর স্মৃতিতে জীবন্ত হয়ে আছে। ওই ইতিহাস তিনি বললেন এভাবে, “জুন মাসের শেষের দিকের ঘটনা। আমাদের গ্রুপে ১৫-২০ জন। কমান্ডে আব্দুল হান্নান ভাই। তবে মোল্লা আব্দুল রফিক ও কুষ্টিয়ার হাদী ভাইয়ের গ্রুপও এ অপারেশনে জয়েন করেছিলেন। হাতে তখন অস্ত্র ছিল কম। ফলে প্রত্যেকেই দুটি করে গ্রেনেড নিই। রাত তখন দেড়টা হবে। আলমডাঙ্গায় ঢুকেই থানায়, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও পাকিস্তানের দালালদের বাড়ি গিয়ে একসাথে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটাই। ৩০ থেকে ৩৫টি গ্রেনেডের বিস্ফোরণে গোটা আলমডাঙ্গা কেঁপে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্তিত্ব দারুণভাবে জানান দেয় ওই অপারেশনটি।”
পরে চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুরে যাওয়ার রাস্তায় এক অপারেশনে মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর হাসপাতালে। শেষে চিকিৎসা হয় কলকাতার ব্যারাকপুর সামরিক হাসপাতালে (বেইস হাসপাতাল)। চিকিৎসা চলে চার মাস। অপারেশনের পর ডান পা-টা ২ মিলিমিটারের মতো ছোট হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছেন বয়স যত বাড়বে, কষ্টও তত বাড়বে। কবরে যাওয়ার আগপর্যন্ত এই কষ্টটা থাকবে তার।
স্বাধীনতা লাভের পর বাড়িতে এসে বাবার মৃত্যুর সংবাদ পান মুক্তিযোদ্ধা রমজান আলী খান। লোকমুখে তার মা খবর পেয়েছিলেন ছেলেও গুলি খেয়ে হাসপাতালে। দেশ স্বাধীন হয় কিন্তু ছেলে ফিরছে না। মা ধরেই নেন তার বড় ছেলে রমজানও বেঁচে নেই। মনের কষ্টে পাথর হয়ে যান তিনি। ছেলেকে পেয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। অতঃপর চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন। মায়ের বুকে জমানো কষ্টগুলো তখন বৃষ্টি হয়ে ঝরে। এসব কথা বলতে গিয়ে এই বীরেরও চোখ ভিজে যায়।
তার সঙ্গে কথা হয় স্বাধীনতা পরবর্তী দেশ নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা রমজান আলী অকপটে বলেন, “বঙ্গবন্ধুর ডাকেই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। গোটা পরিবারই তার ভক্ত। কিন্তু স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতেও ভয় পেয়েছি।”
কেন?
তার ভাষায়, “অস্ত্র জমা দিয়েছি। তবুও জানতে চাওয়া হয়েছে অস্ত্র কই? রক্ষীবাহিনী আসছে অস্ত্র উদ্ধারের নামে ধরতে। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে তারা। আবার রক্ষীবাহিনীকেও মারা হয়েছে। এটা স্বীকার করতেই হবে। তখন ভয়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টাও দিতে পারিনি আমি।”
রমজান আরও বলেন, “স্বাধীনতা লাভের পর আমার নেতা (বঙ্গবন্ধু) বললেন তোমরা আগে যা করতে সেটাই কর। আমার বাবা শহীদ হলেন। তার বাজারের ব্যাগ আমি টানব কেমনে। টাকা কোথায় পাব। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কোনো গাইডলাইন করা হয়নি তখন। অস্ত্র যখন জমা দিলাম তখন তো মিলিশিয়া ক্যাম্পে রেখেও দেশের কাজে আমাদের লাগানো যেত। এটা না করার ফলে যা ঘটল, স্বাধীনতাবিরোধীরা আমাদের ভেতর ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদেরই হত্যা করা শুরু করল। বামপন্থিদের একটি গ্রুপও অনেক মুক্তিযোদ্ধা মারছে। এগুলোও তো ইতিহাস। যদি সত্য না বলি তাহলে কীসের মুক্তিযোদ্ধা হলাম।”
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড জাতির জন্য ঘৃণ্য ইতিহাস রচনা করেছে বলেন মনে করেন এই মুক্তিযোদ্ধা। তবে এ হত্যাকাণ্ডে কারা দায়ী সেটি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলে ধরেন এভাবে, “বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করছে যারা, তারা তো আওয়ামী লীগের লোক— এটাও জোর দিয়ে বলা প্রয়োজন। খন্দকার মোশতাক কি আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন না, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যে সরকার গঠন করা হয়েছিল সেটাকেও স্বীকৃতি দিয়েছিল তখনকার আওয়ামী লীগ নেতারা। যে সকল বিপথগামী সেনাসদস্যরা হত্যায় যুক্ত ছিল তাদের কথা অবশ্যই বলব। কিন্তু কাদের শেল্টারে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেটাও তো তুলে ধরতে হবে। তবে বঙ্গবন্ধু অপরাধ করেছিলেন এমন প্রচারের মাধ্যমে ওই হত্যাকাণ্ডটিকে বৈধতা দেওয়ার কৌশলটাকেও আমি খুব ঘৃণা করি।”
বাবা একাত্তরে শহীদ হওয়ায় স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত একটা চিঠি যায় রমজান আলী মায়ের কাছে, সঙ্গে ছিল এক হাজার টাকাও। শহীদ পরিবার হিসেবে এরপর আর কেউই খোঁজ নেয়নি তাদের। এ নিয়ে আক্ষেপ করে এই বীর বলেন, “তখন প্রতিরক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের রেকর্ডেও শহীদ হিসেবে বাবার নাম উঠেছে। আমার মুক্তিযোদ্ধা সনদেও বাবা শহীদ উল্লেখ আছে। কিন্তু রাষ্ট্র তো শহীদদের কোনো তালিকা করেনি। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হওয়ায় আমার ইতিহাস লেখা আছে। কিন্তু দেশের জন্য জীবন দিয়েও বাবার নাম ইতিহাসে নেই।”
রমজান আলী আরও বলেন, “শহীদ পরিবারগুলো এখনও অবহেলিত ও অসম্মানিত। আমার এলাকার ১২-১৪ জন লোককে পাকিস্তানি আর্মি ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। তাদের পরিবারের খোঁজও নেয় না কেউ। অথচ লাখো শহীদের রক্তের ওপরই স্বাধীন এই দেশটা দাঁড়িয়ে। তাদের তালিকা করা এবং শহীদ পরিবারগুলোকে স্বীকৃতি প্রদান রাষ্ট্রের দায়িত্বেরই অংশ ছিল! এটি না করলে শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করা হবে বলেই মনে করি।”
প্রজন্মের প্রতি পাহাড়সম আশা মুক্তিযোদ্ধা রমজান আলী খানের। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশেই তিনি বললেন শেষ কথাগুলো, ঠিক এভাবে, “দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং লড়াইয়ের ইতিহাসগুলো তোমরা জেনে নিও। মনে রেখো দেশের জন্ম ও শেকড়ের ইতিহাস না জানলে খুব বেশি এগোতে পারবে না। আমরা তো থাকব না। তোমারই দেশটাকে সঠিক পথে এগিয়ে নিও।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
© 2024, https:.