আদিবাসী

বাহাপরব

সাঁওতালদের অন্যতম প্রধান উৎসব ‘বাহাপরব’। ‘বাহা’ মানে ‘ফুল’ বা ‘কুমারীকন্যা’ আর ‘পরব’ মানে ‘অনুষ্ঠান’ বা ‘উৎসব’। প্রতি চৈত্রের শেষে সাঁওতাল গ্রামগুলোতে চলে এই উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। দেবতা বা বোঙ্গার সন্তুষ্টি লাভই এর উদ্দেশ্য। এই উৎসবের আগে সাঁওতাল নারীরা ফুল উপভোগ করা থেকেও বিরত থাকে।

‘বাহাপরব’ উৎসবটি তিন দিনের। তবে প্রথম দিনের অনুষ্ঠানই প্রধান। নিয়ম মেনে এক দিন আগে সাঁওতাল গ্রামে ‘জাহের থান’ ও ‘মাঝি থান’ নানাভাবে সাজানো হয়। গ্রামের এক প্রান্তে নির্দিষ্ট স্থানে চলে পূজার আনুষ্ঠানিকতা।

এ উপলক্ষে নির্দিষ্ট দিনে ‘জাহের থানে’ শালগাছের খুঁটি দিয়ে অন্যান্য বোঙ্গার জন্য প্রতীক হিসেবে ছোট ছোট কয়েকটি চালাঘর তৈরি করা হয়। পূজার জায়গাটি নিকানো হয় গোবর দিয়ে। চালের গুঁড়া দিয়ে আঁকা হয় চমৎকার সব আলপনা।

উৎসবের দিনে পুরোহিত বা মহতকে বাড়ি থেকে বন্দনা করে পূজাস্থলে নিয়ে আসে সাঁওতালরা। এ সময় তিনি উচ্চকণ্ঠে মন্ত্র পাঠ করেন।

অতঃপর বলি দেওয়া হয় কয়েকটি লাল মুরগি বা পশু। এ সময় পুরোহিত গ্রামের কল্যাণের জন্য দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করেন। শেষে খিচুড়ি রান্না করে গ্রামের সবাইকে খাওয়ানো হয়।

৭ আগস্ট ২০২৪, কালের কণ্ঠ

বিকেলের দিকে পুরোহিত সাঁওতাল গ্রামের বাড়িগুলোতে গমন করেন। এ সময় তাঁর মাথায় থাকে শাল ফুলের ডালা। একজন যুবক মাটির কলসিতে এক কলসি জল ভরে মাথায় নিয়ে তাঁর সঙ্গে এগোতে থাকেন। একেকটি বাড়ির ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় পুরোহিত প্রত্যেক গৃহস্থ নারীকে ঝুড়ি থেকে পবিত্র শাল ফুল প্রদান করেন। তারা শাল ফুল গ্রহণ করে পরম ভক্তির সঙ্গে। তবে কোনো কোনো অঞ্চলে পূজাস্থল থেকেই নারীদের শাল ফুল দেওয়া হয়। সাঁওতালদের বিশ্বাস, বাহাপরবে এভাবেই ফুলরূপে দেবতা বা বোঙ্গা তার ঘরে প্রবেশ করেন।

উৎসবের দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানকে বলা হয় ‘বাহা বাস্কে’ (এক রাতের বাসি)। এদিন সাঁওতালরা একে অন্যের গায়ে পানি ছিটায়। তাদের বিশ্বাস, এর মধ্য দিয়ে পুরনো হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা দূর হয়ে তৈরি হয় বন্ধুত্বের সেতুবন্ধ। তৃতীয় দিনটিতে নানা আয়োজনের পাশাপাশি সাঁওতাল নারী-পুরুষ সম্মিলিত বাহা দান ও জাতুর দান নাচ পরিবেশন করে থাকেন।

একসময় ‘বাহাপরব’ উৎসবটি পালিত হতো ধুমধামের সঙ্গে। দারিদ্র্য, অবহেলা আর ভূমিকেন্দ্রিক নানা সমস্যায় সাঁওতাল গ্রামে এখন এই উৎসব পালিত হয় ঢিমেতালে। আবার সাঁওতালদের একটি বড় অংশ ধর্মান্তরিত হওয়ায় তারাও বাহাপরব উৎসব পালন করছে কেবল নাচ-গান আর সামান্য কিছু আনুষ্ঠানিকতায়। ফলে এই আদি উৎসবের আদি রূপটি আজ প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালের কণ্ঠের শেষের পাতায়, প্রকাশকাল: ০৭ আগস্ট ২০২৪

© 2024, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button