প্রান্তজনের গ্রামে কারমা উৎসব
কারমা উৎসবটি পালিত হয় প্রতি ভাদ্রের পূর্ণিমার চাঁদে। বিরল প্রজাতির ‘খিল কদম’ গাছের ডাল কেটে এনে বিশেষ আচার মেনে পূজা করা হয় উৎসবে। এ সময় তারা অভাবমুক্তি ও সৌভাগ্য লাভের আকুতি জানায় দেবতা কারাম গোঁসাইয়ের কাছে। তাদের বিশ্বাস, কারাম গোঁসাই একদিন ঠিক ঠিক তাদের ঘরে আসবেন।দুঃখে ভরা জীবনে তখন লাগবে আনন্দের সুবাতাস।
ভাদ্র মাস। গরমে চারদিকে ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা। এর মধ্যেই রওনা হয়েছি একটি লোকোৎসব দেখব বলে। গন্তব্য দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী ঝিনাইকুড়ি গ্রাম।
বিরল উপজেলার হালজায় মৌজার ওই গ্রামটিই আদিবাসী কড়াদের একমাত্র গ্রাম। পূর্বপুরুষদের জাত-ধর্ম ও বিশ্বাসগুলোকে আজও তারা আগলে রেখেছে। এরই অংশ হিসেবে আয়োজন চলছে কারমা উৎসব পালনের।
এই উৎসব পালিত হয় প্রতি ভাদ্রের পূর্ণিমার চাঁদে।
বিরল প্রজাতির ‘খিল কদম’ গাছের ডাল কেটে এনে বিশেষ আচার মেনে পূজা করা হয় উৎসবে। এ সময় তারা অভাবমুক্তি ও সৌভাগ্য লাভের আকুতি জানায় দেবতা কারাম গোঁসাইয়ের কাছে।
গ্রামটিতে যখন পৌঁছি তখন বিকেল হয় হয়। গোত্রপ্রধান বা মাহাতো জগেন কড়ার সঙ্গে আলাপ চলে। খানিক পরেই হৈচৈ।
এক যুবক পার্শ্ববর্তী ধর্মপুরের গহিন শালবন থেকে কেটে এনেছেন ‘খিল কদম’ গাছের একটি ডাল। আমরাও তখন মিশে যাই লোকাচারে।
ঢোল বাজিয়ে বিশেষ ভক্তি দিয়ে দেবতারূপী ডালটিকে কড়ারা নিয়ে আসে পূজাস্থলে। সেখানে আগে থেকেই বাঁশ ও শাপলা ফুল দিয়ে তৈরি করে রাখা ছিল মাড়োয়া। অতঃপর ডালটিকে বরণ করে মাটিতে গেড়ে দেওয়া হয়।
সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। প্রতিটি বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে আঙিনা পরিপাটি করে সাজানো হয়। এ সময় ঘরে ঘরে তেলের পিঠা ভাজার শোঁ শোঁ শব্দ পাওয়া যায়। কড়ারা বলে, তেলের পিঠা ছাড়া কারমা উৎসব হয় না।
উৎসবের শুরুতেই গ্রামপ্রধান বিশেষ আচার মেনে ডালটির সামনে পূজা দেন। মাটি লেপা একটি স্থানে কলাপাতা বিছিয়ে পাশে রাখা হয় একটি কাঁসার থালা। থালায় থাকে প্রদীপ, কাঁচা ছোলা, জুঁই ফুল, শসা ও সিঁদুর। এ সময় দুটি লাল মুরগা (মোরগ) বলি দিয়ে উৎসবের শুভ সূচনা করা হয়।
এই উৎসবে মেয়েরা শাখা, সিঁদুর, টিকলি, খাড়ু পরে নেয়। বলি পর্বের পরেই শুরু হয় উৎসবের পেছনের পৌরাণিক কাহিনি বলার আসর। মূলত এ কারণেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে কারমা বা কারাম উৎসবের বিশ্বাসটি। কাহিনি বলার পর্বে খিল কদম বা কারাম ডালটিকে ঘিরে বসে নারীরা। সেজেগুজে ঘোমটা টেনে বসে তারা। সামনে কাঁসার পেয়ালায় রাখা হয় প্রদীপ, তেলের পিঠা, ছোলা, দূর্বাঘাস ও জুঁইফুল।
গোত্রপ্রধান বা মাহাতো বলতে থাকেন উৎসবের পৌরাণিক কাহিনিটি। মাঝেমধ্যে তিনি উচ্চৈঃস্বরে বলেন—‘ফুল ফেকিয়ে।’ ঠিক তখনই সবাই এক মুঠো জুঁইফুল বা ঘাস ছুড়ে দেয় ডালটির দিকে। কাহিনি শেষে মনের নানা ইচ্ছা নিয়ে সবাই তাদের বানানো তেলের পিঠা বেঁধে দেয় কারমা ডালটির সঙ্গে। উৎসবের এই পর্বটিতে শুধু মেয়েরাই অংশ নিতে পারে। পূজা শেষে উপোসকারীরা উপোস ভাঙে। রাতভর ডালটির চারদিকে নেচে-গেয়ে হাঁড়িয়া খেয়ে আনন্দ করে তারা। ভোরে তা বিসর্জন দেয় নিকটবর্তী নদী বা পুকুরে। আমরা তখন ফিরতি পথ ধরি।
শত অবহেলা ও অভাব-অনটনের মধ্যেও কড়াসহ সমতলের প্রান্তজনরা প্রতি ভাদ্রে ধুমধামের সঙ্গে পালন করে কারমা বা কারাম উৎসবটি। উৎসবে আজও তারা আশায় বুক বাঁধে। সামনেই দেখা মিলবে সৌভাগ্য ও সফলতার। তাদের বিশ্বাস, কারাম গোঁসাই এক দিন ঠিক ঠিক তাদের ঘরে আসবেন। দুঃখে ভরা জীবনে তখন লাগবে আনন্দের সুবাতাস। বেঁচে থাকা ও টিকে থাকার সংগ্রামে কারমা উৎসব এভাবেই প্রান্তজনের প্রেরণা ও মানসিক শক্তি জুগিয়ে আসছে যুগে যুগে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালের কণ্ঠের শেষের পাতায়, প্রকাশকাল: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
© 2024, https:.