প্রশাসন নাকি বালুখেকোরাই শক্তিশালী ?
নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা দিয়ে নদ–নদীর সুরক্ষা ও সংরক্ষণে ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’কে ‘আইনগত অভিভাবক’ উল্লেখ করে আদালত কয়েক বছর আগে এক যুগান্তকারী রায়ও দেয়। কিন্তু তৃণমূলে তার পুরোপুরি বাস্তবায়ন ঘটেনি এখনো। বালু উত্তোলনের নামে নদী হত্যা চলছে।
টাঙ্গাইলের কালিহাতির ঘটনা। ২২ অগাস্ট, বৃহস্পতিবার, দুপুরে উপজেলার ধলা টেঙ্গর ভাবলায় নদী থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করার অভিযোগে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এক ব্যক্তিকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করেন। এর কয়েক ঘণ্টার ভেতরই ওই ইউএনওকে বদলি করা হয়। ফলে ছাত্র-তরুণ-যুবসহ সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সবার ধারণা অবৈধ বালু উত্তোলনকারীরাই এই বদলির সঙ্গে যুক্ত। ছাত্র-জনতা এখন প্রকাশ্যেই প্রশ্নও তুলছে, প্রশাসনের চেয়ে বালুখেকোরাই কি শক্তিশালী এদেশে?
ওইদিন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের সিনিয়র সহকারী সচিবের স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে কালিহাতির উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহাদাত হুসেইনকে বদলি করে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলায় পদায়ন করা হয়। অথচ বিসিএস প্রশাসনের ৩৪ ব্যাচের ওই কর্মকর্তা মাত্র ১১ মাস আগে কালিহাতিতে যোগদান করেছেন।
নানা অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সারাদেশেই এখন দাবি তুলছে ছাত্র-তরুণ-যুবরা। নানা জায়গায় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের দিকেও অভিযোগের তীর ছুড়ে দিচ্ছে তারা। প্রতিদিনই এসব খবর উঠে আসছে গণমাধ্যমে। কিন্তু একেবারেই ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে কালিহাতি উপজেলায়।
ইউএনওর বদলির খবরটি ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র-জনতার মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বৃহস্পতিবার থেকেই তারা মশাল মিছিল বের করে সড়ক অবরোধ করে। বদলির আদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন, মিছিল ও বিক্ষোভ করছে। রোববার সকালে কয়েক হাজার ছাত্র-জনতা উপজেলার প্রধান ফটক আটকে ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে। তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউএনওর বদলির আদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানায়। কিন্তু যখন লিখছি তখন পর্যন্ত তা প্রত্যাহার করা হয়নি।
কালিহাতিতে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের ঘটনা জানানোর আগে নদী দখল সম্পর্কে খানিকটা ধারণা নেওয়া প্রয়োজন।
জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন বলছে, এদেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৪০৬টির মতো। কিন্তু নদীগুলোর সংকটে পড়ার বড় কারণ এর দূষণ। পাশাপাশি বহু গুণে বেড়েছে নদীপাড়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও নদী দখলের দৌরাত্ম্য। নদী কমিশনের দেওয়া তথ্য মতে, একটিও নদী দখলদারদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। নদীর জায়গা দখল করে বাড়িঘর ও শিল্পকারখানা গড়ে তোলার পাশাপাশি দোকানপাট ও বাজার তোলা হয়েছে। ঘরবাড়ি করে স্থানীয়রাও নদী-খালের জমি অবৈধভাবে দখল করেছে। ফলে নদীদূষণসহ মূল নদীর প্রবাহ অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এভাবেই হত্যা করা হচ্ছে নদীগুলোকে।
নদী নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতও এক রায়ে বলেছে ‘মানুষের জীবন-জীবিকা নদীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানবজাতির টিকে থাকার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে নদী। নাব্য সংকট ও বেদখলের হাত থেকে নদী রক্ষা করা না গেলে বাংলাদেশ তথা মানবজাতি সংকটে পড়তে বাধ্য।’
আবার সব নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা দিয়ে নদ-নদীর সুরক্ষা ও সংরক্ষণে ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’কে ‘আইনগত অভিভাবক’ উল্লেখ করে আদালত কয়েক বছর আগে এক যুগান্তকারী রায়ও দেয়। কিন্তু তৃণমূলে তার পুরোপুরি বাস্তবায়ন ঘটেনি এখনো। বালু উত্তোলনের নামে নদী হত্যা চলছে।
অবৈধভাবে বালু উত্তোলন নদীকে ধ্বংস করারই নামান্তর। কিন্তু রাতারাতি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার সবচেয়ে লোভনীয় পথগুলোর একটি। এ কারণেই যে কোনো রাজনৈতিক সরকারের আমলেই নদী থেকে অবৈধ বালি উত্তোলন থেমে থাকেনি। বরং এ কাজে সবসময় যুক্ত ছিল সরকারের উচ্চমহলও।
আইন অমান্য করে দেশের বিভিন্ন নদী ও সমুদ্র উপকূল থেকে কীভাবে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা এ নিয়ে গতবছর বেসরকারি সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার এক সমীক্ষা প্রকাশ করে। ‘বাংলাদেশে বালু উত্তোলন মানচিত্র’ শিরোনামে ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছে, নদী থেকে বালু উত্তোলনের জন্য সরকারিভাবে দেশের ৭০৭টি স্থান নির্ধারণ করা আছে। যার মধ্যে ৩৮২টি বালুমহাল বিভিন্ন ব্যক্তিকে ইজারাও প্রদান করা। এ ছাড়া বাংলাদেশের ৭৭টি নদীর ১৩২টি পয়েন্ট থেকে ২৬৫ ব্যক্তি অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন। যার মধ্যে অন্তত ৫৪ জন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। ১৩২টি অবৈধ বালু উত্তোলন কেন্দ্রের মধ্যে পদ্মায় ২০টি, যমুনায় ১৩টি, মেঘনায় ১২টি, ব্রহ্মপুত্রে ছয়টি, সুরমা ও পিয়াইন নদীতে পাঁচটি, তিস্তায় চারটি, সাঙ্গুতে তিনটি এবং ইছামতিতে তিনটি কেন্দ্র রয়েছে। বাকিগুলো দেশের অন্যান্য নদীতে অবস্থিত।
অবৈধ বালি উত্তোলনকারীদের ঠেকাতে প্রশাসনও অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়ে। তবে এটাও ঠিক প্রশাসনের একটি চক্র মোটা অংকের মাসোহারার বিনিময়ে বালি উত্তোলনে সহযোগিতাও করে। এর ব্যতিক্রম থাকলেও তাদের পক্ষে টিকে থাকা প্রায় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতি, সদর ও ভূঞাপুর উপজেলায় যমুনা এবং এর শাখা নদীগুলো থেকে অবৈধ্ভাবে বালি উত্তোলনের দৌরাত্ম্য চলে সীমাহীন। কয়েক বছর আগে কালিহাতি উপজেলায় এক নারী ইউএনওর সাহসিকতার কথাও আমাদের জানা। ওই সময় বালিখোরদের দৌরাত্ম্য তিনি বন্ধ করেছিলেন কঠোর হাতে। প্রভাবশালীদের কোটি টাকার প্রলোভনও তাকে সরকারি দায়িত্ব পালনে টলাতে পারেনি। জেলা প্রশাসকও শক্তি নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
কালিহাতির তৎকালীন সরকারদলীয় সংসদ সদস্যও যুক্ত ছিলেন বালুখেকোদের একটি অংশের সঙ্গে। ফলে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করতে দেওয়ার অনুরোধ না রাখায় ওই ইউএনওকে তিনি নানাভাবে হেনস্থা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার সততার সঙ্গে পেরে ওঠেন না। বরং ওই ইউএনও নদী থেকে অবৈধভাবে উত্তোলিত বালি জব্দ করে সরকারি নিয়মে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করার উদ্যোগ নেন। এভাবে প্রায় আট কোটি টাকা তিনি সরকারি তহবিলে জমা প্রদান করেছিলেন। যা বালি উত্তোলনকারীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে।
এমন সাহসী কাজের জন্য ওই ইউএনও কিন্তু পুরস্কৃত হননি। বরং কয়েক মাসের মধ্যেই তাকে বদলি করে দেওয়া হয়। শোনা যায় তৎকালীন মন্ত্রী পরিষদ সচিবের নির্দেশেই বদলি করা হয়েছিল তাকে।
আর এ ঘটনা শুধু অবৈধ বালি উত্তোলনকে উৎসাহিতই করেনি বরং প্রশাসনের কোন অফিসার যেন ওদের বিরুদ্ধে কঠোর না হন সেই বার্তাও দেওয়া হয়েছিল। যা মোটেই কাম্য ছিল না। ইউএনও শাহাদাত হুসেইনের ক্ষেত্রেও কি একই ঘটনার পূণরাবৃত্তি ঘটেছে?
শাহাদাত হুসেইন কেমন ছিলেন–সেটি জানা যায় গণমাধ্যমে উঠে আসা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ভাষ্য থেকে। তারা বলছেন, ইউএনও শাহাদাত হুসেইন একজন সৎ, নির্ভীক ও পরিশ্রমী অফিসার। জনমানুষের জন্য ভালোবাসা নিয়ে কাজ করেন তিনি। রাজনৈতিক চাপে কোন অন্যায় কখনও মেনে নেননি। কালিহাতিতে যোগদানের পর থেকেই শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে দারুণ সব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আন্তঃউপজেলা বির্তক, কুইজ, সুন্দর হাতের লেখা ও বানান প্রতিযোগিতার আয়োজন, গোটা উপজেলার যুবদের নিয়ে নানা ধরণের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার উদ্যোগ, শিল্পকলা একাডেমিতে বিষয়ভিত্তিত ক্লাস চালু করেছেন। পাশাপাশি গ্রীন কালিহাতি নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে পরিবেশ আন্দোলনেও যুবকদের সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছেন তিনি।
বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় উৎসাহ প্রদান, ভাল শিক্ষকদের সম্মাননা প্রদানসহ সার্বিকভাবে উপজেলাটিতে একটি শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করেন ইউএনও শাহাদাত। এছাড়া ভূমিহীন, অসহায়, হতদরিদ্রদের পাশে সরকারি অর্থে অথবা নিজস্ব অর্থে সাধ্য মতো সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন। সম্প্রতি তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য উপজেলায় ‘মিডিয়া অ্যান্ড আইটি সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এভাবেই নানা উদ্যোগের কারণে গোটা উপজেলার ছাত্র-যুব-জনতার প্রাণের মানুষ হয়ে ওঠেন শাহাদাত হুসেইন।
আমরা আশ্বস্ত হই এই ভেবে যে, ভাল কাজের উদ্যোগ ও বাস্তবায়নের পরিবেশ এদেশে এখনও আছে। সবকিছু নষ্টদের দখলে বা সব মানুষই নষ্ট হয়ে যায়নি। পেশাগত কাজের বাইরে গিয়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু সাহসী ও উদ্যোগী মানুষের পাশে রাষ্ট্র শক্তি নিয়ে দাঁড়াবে এমনটাই প্রত্যাশা সবার।
বদলি একজন সরকারি কর্মচারীর নিয়মিত ঘটনা। ইউএনও শাহাদাত হুসেইন যেখানেই যাবেন নিজের কর্মগুণে সেখানেই আলো ছড়াবেন।কিন্তু একজন সাহসী ও সৎ অফিসার ভাল কাজ করেও মন খারাপের অনুভূতি নিয়ে চলে যাবেন আর বালিখেকোরা মুখটিপে হাসবেন– এমনটা মেনে নেওয়া সত্যি কঠিন। তাই কোনো রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি নয়, কালিহাতির ছাত্র-জনতার দাবি বিবেচিত হোক সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরকার জিরো ট্লারেন্স দেখাক। সত্যের ও সাহসের জয় হোক এদেশে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৬ আগস্ট ২০২৪
© 2024, https:.