সেই রাজাকার
তবু ভালো অবশেষে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে। তবে কেউ কেউ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারার জন্য সরকারের ভেতরেই ঘাপটি মেরে থাকা জামায়াত আদর্শের ব্যক্তিদেরই ইঙ্গিত করছেন। যাদের চিহ্নিত করার দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়।
যখন লিখছি তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করা দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এর আগে ১৯৭২ সালে নিষিদ্ধ হয়েছিল এ দলটি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের অভিযোগ ছিল তখন। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা এ দলটি আবারও নিষিদ্ধ হচ্ছে প্রায় অর্ধশতক পর!
কিন্তু এ দলটিকে বহুকাল আগে নিষিদ্ধ করা দাবি ওঠে। নব্বইয়ের দশকে এ দাবি সামনে আসে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন থেকে। এরপর ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময়ও জোরালো হয় জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিটি।এরপর আদালতের রায়ে এ দলটি নিবন্ধনও খুইয়ে ফেলে। ফলে এদেশে তাদের নির্বাচন করার পথ বন্ধ হয়ে যায়।
তবুও সাংগঠনিকভাবে জামায়াত ছিল সক্রিয়। গত নির্বাচনের আগেও দলীয়ভাবে রাজপথে তারা মিছিল ও সমাবেশ করেছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এ নিয়ে শক্ত অবস্থান বা কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার।
ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস এবং সংখ্যার দিক থেকে সর্বাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে এত বড় হত্যাযজ্ঞ করা সম্ভব হতো না, যদি না জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও নেযামে ইসলামীর মত দলগুলো সহযোগিতায় এগিয়ে যেত।
স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশে এসব দলের নেতাদের রাজনীতি করার অধিকার থাকার কথা নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধও করেছিলেন।কিন্তু পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র কায়েমের নামে স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলোকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনেন। ফলে তারা স্বাধীন দেশে রাজনীতি করার বৈধতা পায় এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পাকাপোক্ত ভিত্তি স্থাপন করে। পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি করার অধিকার দেওয়ার এমন নজিরও আর নেই।
একাত্তরে এ দলটি ও তার নেতাদের ভূমিকা কী ছিল? শুরু থেকেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে গণহত্যায় শক্তি যুগিয়ে, সহায়ক বাহিনী গঠন করে, তাদের পক্ষে মিটিং, মিছিল, সমাবেশ করে এবং পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে প্ররোচিত করে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম।
মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটি গঠনের সঙ্গে যেসকল রাজনৈতিক ব্যক্তিরা সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি এবং মুসলিম লীগ নেতা খাজা খয়েরউদ্দিন। পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খানের পরামর্শ ও সহযোগিতায় তারা গঠন করে শান্তি কমিটি। প্রাথমিক পর্যায়ে জামায়াত ও অন্যান্য দলের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ১৪০ সদস্যের ‘ঢাকা নাগরিক শান্তি কমিটি’। পরে সারা দেশেই তারা কমিটি গঠনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার কাজে লিপ্ত থাকে।
১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। করাচীতে জামায়াত অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার সময় পাকিস্তান রক্ষা ও মানুষের জীবনের নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে গোলাম আযম বলেন, “কোন ভাল মুসলমানই তথাকথিত ‘বাংলাদেশ আন্দোলনে’র সমর্থক হতে পারে না। তার ভাষায়, ‘পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের (মুক্তিযোদ্ধা) নির্মূল করার জন্য একমনা ও দেশ প্রেমিক লোকেরা একত্রে কাজ করে যাচ্ছে। রাজাকাররা খুবই ভাল কাজ করছে।” (সূত্র: দৈনিক পাকিস্তান, ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)।
২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। হোটেল এম্পায়ারে ঢাকা শহর জামায়াত কর্তৃক প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী আব্বাস আলী খান ও রাজস্ব মন্ত্রী মওলানা একেএম ইউসুফকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গোলাম আযম বলেন, “জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা মুসলিম জাতীয়তাবাদের আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদকে মেনে নিতে রাজী নয়।” তিনি আরও বলেন, “জামায়াতের কর্মীরা শাহাদাৎবরণ করে পাকিস্তানের দুষমনদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে তারা মরতে রাজী তবুও পাকিস্তানকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করতে রাজী নয়।” (সূত্র: দৈনিক পাকিস্তান, ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ৭০ মিনিট স্থায়ী এক বৈঠকও হয় গোলাম আযমের। বৈঠকের পর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি তথাকথিত মুক্তিবাহিনীকে শত্রুবাহিনী রূপে আখ্যায়িত করে বলেন, “তাহাদিগকে মোকাবিলা করার জন্য রাজাকাররাই যথেষ্ট।”
একাত্তরের মে মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তার জন্য খুলনার খান জাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন পাকিস্তানপন্থী ব্যক্তিকে নিয়ে গঠন করা হয় রাজাকার বাহিনী।
পরে অর্ডিন্যান্স জারি করে আনসার বাহিনীকে বিলুপ্ত করে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তর করে পাকিস্তান সরকার। এ বাহিনীটি গঠনের পেছনে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন নেতা মওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ (একেএম) ইউসুফ। প্রথম দিকে রাজাকার বাহিনী ছিল শান্তি কমিটির অধীনে। এতে প্রায় ৫০ হাজার সদস্য ছিল। যারা প্রতি মাসে জনপ্রতি ভাতাও পেতেন। পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখানো এবং যুদ্ধে সামনে থেকে বিশেষ ভূমিকা রাখে রাজাকাররা।
২৮ নভেম্বর ১৯৭১। করাচিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি বলেন, “রাজাকাররা আমাদের বীর সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় হামলার মোকাবিলা করেছেন।” তিনি দুস্কৃতকারীদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) দমনের জন্য রাজাকারদের হাতে আরও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দেয়ার দাবি জানান।
২৫ অক্টোবর সিলেটের এক জনসভায় মিত্রবাহিনীকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে ইউসুফ বলেন, “আমাদের ওপর যদি কোনো যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়, তবে বীর সেনাবাহিনী ও বীর রাজাকাররা অবশ্যই তার পাল্টা আঘাত করবে।”
একাত্তরে আলবদর নামে একটি সশস্ত্র বাহিনীও গড়ে তোলা হয়। এর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৩ হাজার। ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য ছাড়াও অবাঙালি ও পাকিস্তানপন্থি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অনেকেই যোগ দিয়েছিল আলবদর বাহিনীতে। আলবদররা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলীর নির্দেশে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নও করেছে তারা।
এ বাহিনীর প্রধান ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের (বর্তমানে ইসলামী ছাত্রশিবির) সমগ্র পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী, উপ-প্রধান ছিলেন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। কাদের মোল্লা ও কামরুজ্জামান–এরাও ছিলেন আলবদর নেতা। স্বাধীনতাবিরোধী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বিএনপি সরকারের আমলে গুরুপূর্ণ মন্ত্রী হয়েছিলেন।
১৪ নভেম্বর ১৯৭১। দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত হয় নিজামীর লেখা একটি নিবন্ধ। ওই নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, “আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে, পাকবাহিনীর সহযোগিতায় এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ সমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে।”
২২ অগাস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর মাওলানা মাদানীর স্মরণ সভায় নিজামী বলেন, “পাকিস্তানকে যারা বিচ্ছিন্ন করতে চায় তারা এ দেশ থেকে ইসলামকেই উৎখাত করতে চায়।” (সূত্র: ২৩ অগাস্ট ১৯৭১, দৈনিক সংগ্রাম)। একই পত্রিকায় ৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘আলবদর’ শীর্ষক একটি লেখায় বলা হয়েছে, “আলবদর, একটি নাম! একটি বিস্ময়! আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা! যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী, আলবদর সেখানেই।”
যশোর রাজাকার সদর দফতরে সমবেত রাজাকারদের উদ্দেশ্য করে এক ভাষণে নিজামী বলেন, “জাতির এই সংটজনক মুহূর্তে প্রত্যেক রাজাকারের উচিত ইমানদারীর সাথে তাদের উপর অর্পিত এ জাতীয় কর্তব্য পালন করা এবং ওই সকল ব্যক্তিকে খতম করতে হবে যারা সশস্ত্র অবস্থায় পাকিস্তান ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে।” (সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)।
এছাড়াও একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের সহযোগী হিসেবে আলশামস নামে একটি প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠন করে। এর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজারের মতো। ইসলামী ছাত্র সংঘের বাছাই করা কর্মীদের নিয়ে সংগঠিত হলেও আলশামস বাহিনীর সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সংযোগ ছিল। তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মারবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতার পাশাপাশি নিজেরাও হত্যাযজ্ঞে অংশ নিয়েছিল।
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর ঢাকা মহানগরীর প্রধান ছিলেন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। তার প্রধান আড্ডা ছিল ফকিরাপুল গরম পানির গলিতে, ফিরোজ মিয়ার ১৮১নং (বর্তমান ২৫৮নং) বাড়িটিতে। ফিরোজ মিয়া ছিলেন ওই এলাকার রাজাকার কমান্ডার।
তার বাড়ি থেকেই পরিচালিত হতো রাজাকারদের বিভিন্ন সভা, সশস্ত্র ট্রেনিং, বিভিন্ন অপারেশন, রাজাকার রিক্রুটমেন্ট ইত্যাদি। এছাড়া এখানেই মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লোকদের ধরে এনে নির্যাতন চালানো হতো।
২৫ অক্টোবর ১৯৭১। ইসলামী ছাত্রসংঘের এক সম্মেলনে মুজাহিদ “পাকিস্তানের ছাত্র-জনতাকে দুস্কৃতকারী (মুক্তিযোদ্ধা) খতম করার দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।” (সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম, ২৬ অক্টোবর ১৯৭১)।
৭ নভেম্বর ‘ঐতিহাসিক বদর দিবস’ উদযাপন করতে গিয়ে ঢাকার বায়তুল মোকাররমে ইসলামী ছাত্র সংঘের এক সমাবেশে আলী আহসান মুজাহিদ তার চার দফা ঘোষণায় বলেন, “যতদিন পর্যন্ত দুনিয়ার বুক থেকে হিন্দুস্তানের নাম মুছে দেয়া না যাবে ততদিন পর্যন্ত আমরা বিশ্রাম নেবো না। আগামীকাল থেকে হিন্দু লেখকদের বই অথবা হিন্দুদের দালালী করে লেখা পুস্তকাদি লাইব্রেরীতে কেউ স্থান দিতে পারবে না, বিক্রি বা প্রচার করতে পারবে না। যদি করেন তবে পাকিস্তানের অস্তিত্বে বিশ্বাসী স্বেচ্ছাসেবকরা তা জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেবে।” (সূত্র: দৈনিক পাকিস্তান, ৮ নভেম্বর ১৯৭১)।
২৩ নভেম্বর প্রকাশিত জামায়াতের এক প্রচারপত্রে বলা হয়, “মনে রাখবেন আপনারা পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্যই কেবল যুদ্ধ করছেন না, এ যুদ্ধ ইসলামের। নমরুদের হাত থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য আমাদের আমীরের (গোলাম আযম) নির্দেশ পালন করুন।”
একাত্তরে পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি জাতিসংঘে যান এবং পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “পাকিস্তানি সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানে হামলা চালিয়ে অন্যায় কিছু করেনি। স্বাধীনতা সংগ্রামের নামে সেখানে যা চলছে, তা হলো ভারতের মদদপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের উচিত সেটাকে পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার হিসেবে গ্রহণ করা।”
স্বাধীনের পরে স্বাধীনতাবিরোধী এই শাহ আজিজুর রহমানকে দালাল আইনে গ্রেফতার করা হয়। পরে ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে সরকারের সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হলে তিনি মুক্তি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন মুসলিম লীগের একটি বড় অংশ নিয়ে শাহ আজিজ জেনারেল জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী দলে যোগ দেন এবং তার হাত ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বনে যান।
যে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান সেই দেশের লাল-সবুজ পতাকা ওড়ে তার গাড়িতে। ফলে কলঙ্কিত হয় ইতিহাস আর রক্তাক্ত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়। এ স্বাধীনতাবিরোধীর কবর এখনও রয়েছে সংসদ ভবন এলাকায়, যা হতাশা জাগায়।
একাত্তরের এ পরাজিত শক্তি কেবল একটি রাজনৈতিক দল হিসেবেই আর্বিভূত হয়নি, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সমাজ-অর্থনীতিতেও তারা শক্ত ভিত তৈরি করে রেখেছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে ব্যক্তির বিচার হলেও দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারের দাবিটিও ছিল খুবই যৌক্তিক। কিন্তু রাজনীতিকদের কাছে অজ্ঞাত কারণে সে দাবিটি উপেক্ষিত হয়েছে বারবার।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর তখনকার আমির গোলাম আযমকে ২০১৩ সালে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণেও জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ হিসেবে আখ্যায়িত করে আদালত। তবুও নিষিদ্ধ করা হয়নি এ দলটিকে।
সচেতন সমাজ ও গবেষকরা বলছেন, যুদ্ধাপরাধীর দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করায় কালক্ষেপনের সুযোগেই বর্তমান ক্ষমতাসীন দলসহ প্রশাসন ও সমাজের নানা স্তরে পরিচয় গোপন রেখে এই দলের কর্মী ও অনুসারীরা পাকাপোক্ত আসন তৈরি করে নিয়েছে। ফলে মাঝেমধ্যেই অন্য আন্দোলনের সুযোগে তারা তাদের শক্তির জানান দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। আবার ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ না করে শুধুমাত্র জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করলে এ দলের অনুসারীরা অন্য দলে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ পাবে কিনা, সেটি দেখাও বিশেষ প্রয়োজন।
জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তবু ভালো অবশেষে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে। তবে কেউ কেউ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারার জন্য সরকারের ভেতরেই ঘাপটি মেরে থাকা জামায়াত আদর্শের ব্যক্তিদেরই ইঙ্গিত করছেন। যাদের চিহ্নিত করার দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়। আবার ক্ষমতাসীন দলে বিভিন্ন সময়ে জামায়াত আদর্শের কর্মীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে কিনা সেটি খুঁজে বের করতে না পারলে এই রাজাকাররাই হয়ে যাবে একাত্তরের সেই রাজাকার।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১ আগস্ট ২০২৪
© 2024, https:.