আদিবাসী

চন্দ্র ও সূর্যের বৃত্তান্ত

আদিবাসীদের কাছে চন্দ্র ও সূর্য দেবতার আসনে আসীন। কোন কোন জাতির কাছে এরা ভাই-বোন, কেউ বলছে স্বামী-স্ত্রী, কিংবা কেউ বলছে এরা দুই ভাই। ফলে এদের জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কেও রয়েছে নানা কাহিনি।

এসব কাহিনির ভিন্নতা থাকলেও প্রায় সব জাতির পূজা-পার্বণ ও নানা আচার আবর্তিত হয় মূলত চন্দ্র ও সূর্যকে ঘিরেই। মান্দি বা গারোদের বিশ্বাস, ভেজা পৃথিবীকে শুকাতেই চন্দ্র ও সূর্যের জন্ম হয়। এ আদিবাসীরা বিশ্বাস করে পৃথিবী সৃষ্টির আগে চারদিকে ছিল পানি আর পানি। কোথাও স্থলের চিহ্ন নেই। সবকিছু অন্ধকারে আচ্ছন্ন।

এমন অবস্থা দেখে ভগবান তাতারা রাবুগা পৃথিবী সৃষ্টির চিন্তা করলেন। তিনি নস্ত নুপাস্তকে স্ত্রীলোকের আকার দিয়ে পাঠালেন। সঙ্গে দিলেন কিছু বালি। নস্ত নুপাস্ত প্রথমে মাকড়সার জালে আশ্রয় নিয়ে সমস্ত জলরাশির ওপর সে জাল বিস্তার করলেন।

তারপর তিনি সঙ্গে আনা বালি মুষ্টিবদ্ধ করে পানিতে নিক্ষেপ করে বললেন, অনন্ত জলরাশির নিচ থেকে মাটি নিয়ে এসো। যথা সময়ে মাটি আসলো এবং তিনি সে মাটি দিয়ে পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। গারো ভাষায় একে বলে ‘মেন পিলটি’।

পৃথিবী সৃষ্টির পর ভগবান তাতারা রাবুগার কাছে তা ভেজা মনে হলো। তাই তিনি তা শুকাতে আসিমা দিংগাসীমার পুত্র ও কন্যাকে স্থাপন করলেন পৃথিবীতে। এরাই সূর্য (রেঙ্গরা বলসা) ও চন্দ্র (বীরে জিতজে)। তাই মান্দি বা গারোদের কাছে চন্দ্র ও সূর্য ভাই-বোন।

কিন্তু চন্দ্র কেন কম আলো দেয়? চন্দ্র ছিল খুবই সুন্দরী। ভাই সূর্য থেকে ছিল অনেক বেশি উজ্জ্বল। এ নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায়ই তৈরি হতো মনোমালিন্য। সূর্য বোনের রূপ-লাবণ্যে হিংসা করতো। দুই ভাইবোনে ঝগড়া চলে হরহামেশাই। তাদের মা তা থামাতেন।

একদিন তাদের বাড়িতে রেখে জরুরি কাজে মা গেলেন বাইরে। সে সুযোগে ভাই-বোনে শুরু হয় তুমুল ঝগড়া। সে ঝগড়া রূপ নেয় হাতাহাতিতে। ক্ষেপে যায় সূর্য। মুঠি ভরা কাদা নিয়ে বোন চন্দ্রের মুখে তা লেপ্টে দেয়। এতে বোনও রেগে যায়। ভাই সূর্যকে শায়েস্তা করতে হবে। তাই মুখের কাদা না ধুয়ে অপেক্ষা করে মায়ের জন্য।

মা বাড়িতে আসতেই চন্দ্র কাদামাখা মুখ দেখিয়ে জানায় ভাইয়ের কুকীর্তির কথা। মা এতে খুশি হন না, বরং চন্দ্রের এমন প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণে ক্ষেপে যান। তারপর মেয়ে চন্দ্রকে অভিশাপ দিয়ে বলেন, ‘চিরকালই তোমার মুখ যেন এমনি কর্দমাক্ত থাকে’। গারোদের বিশ্বাস, সে থেকেই সূর্যের চেয়ে কম আলোর অধিকারিণী হয়েছে চন্দ্র।

আবার খাসিয়া আদিবাসীদের বিশ্বাস, সূর্যের দেওয়া ছাইয়েই চন্দ্র দীপ্ত জ্যোতি হারিয়েছে। চন্দ্র ও সূর্যের জন্ম নিয়ে তাদের সমাজে প্রচলিত আছে একটি কাহিনি। কাহিনিটির ভাবার্থ এমন-

আদি কালের কথা। এক রমণীর ছিল চার সন্তান। তিন মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়েদের নাম সূর্য, জল, অগ্নি। সবার ছোট সন্তান ছেলে, নাম চন্দ্র। বোনেরা কোলেপিঠে করে মানুষ করে তাকে। তখন চন্দ্র ছিল সূর্যের মতোই আলোকদীপ্ত।

বড় হয়ে চন্দ্র মনে মনে প্রেমে পড়ে বড় বোন সূর্যের। সূর্য প্রথমে তা টের পেলেও গুরুত্ব দেন না। কিন্তু কোনভাবেই চন্দ্র নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বরং এক সময় সে বোনকে বিয়ে করার ইচ্ছে প্রকাশ করে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে।

কিন্তু সূর্য তার ছোট ভাই চন্দ্রের প্রেম ও বিয়ের বিষয়টি জানতে পেরে ভীষণ ক্ষেপে যায়। মুষ্টিবদ্ধ করে সে কিছু ছাই এনে চন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘আমি তোমার বড় বোন। মায়ের মতোই তোমাকে কোলেপিঠে করে লালন-পালন করেছি, অথচ তুমি কিনা আমাকে বিয়ে করতে চাও! নির্লজ্জ কোথাকার? দূর হও এখান থেকে।’ বলেই মুঠিবদ্ধ ছাই সে ভাই চন্দ্রের মুখে নিক্ষেপ করে।

চন্দ্র তখন ভয়ে ও লজ্জায় পালিয়ে যায়। সেদিন থেকেই চন্দ্র তার দীপ্ত জ্যোতি হারিয়ে ফেলে। আর পূর্ণিমার সময় চন্দ্রের গায়ে যে কলঙ্কচিহ্ন দেখা যায় তা সূর্যের দেওয়া সেই ছাইয়েরই প্রকাশ। চন্দ্র চলে গেলে তিনবোন সূর্য, জল ও অগ্নি রয়ে যায়। তারাই তার মাকে দেখাশোনা করতে থাকে।

আবার ওরাওঁ আদিবাসীরা বিশ্বাস করে, আদিতে সূর্য তার সন্তান-সন্ততি নিয়ে আকাশেই বিচরণ করত। সূর্যের ছিল প্রখর তাপ। তার সন্তানদের তাপও কম ছিল না। এক একজন ছিল সূর্যের মতোই তেজোদ্দীপ্ত। পিতা আর পুত্রদের তাপে পৃথিবীর সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। নিজেদের বাঁচাতে সবাই ছুটে গেল সূর্যের বোন চাঁদের কাছে।

সবার কথা শুনে সে এক বুদ্ধি আঁটল। চাঁদ জানত, তার ভাই কী কী খেতে পছন্দ করে। সে একদিন খরগোশের মাংস রান্না করে ভাই সূর্যকে দাওয়াত করল। সূর্য বোনের বাড়িতে খরগোশের মাংস খেয়ে তো আত্মহারা। এমন সুস্বাদু মাংস সে আর কখনো খায়নি।

সে বোনকে আড়ালে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এ কীসের মাংস?’ চাঁদ বা চন্দ্র বলল, ‘তুমি হয়ত বিশ্বাস করবে না, এ আমার সন্তানদের মাংস।’

খানিকটা গম্ভীর হয়ে সে সূর্যকে আরো বলল, ‘তোমার সন্তানদের মাংস এর চেয়েও সুস্বাদু হবে’।

প্রিয় বোন চাঁদের কথা শুনে সূর্য বাড়ি ফিরে একে একে তার সব সন্তানকে খেয়ে ফেলল। ফলে পৃথিবীতে তাপ গেল কমে। এভাবে চাঁদের বুদ্ধিতেই রক্ষা পায় পৃথিবী। শুধু পালিয়ে গিয়ে বেঁচে রইলো একটি ‘শুকতারা’।

আদি বিশ্বাসের মানুষেরাই পৃথিবীর নানা ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ধারক ও বাহক। ফলে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য আমাদের অমূল্য সম্পদ। চন্দ্র ও সূর্য নিয়ে আদিবাসী সমাজে প্রচলিত রয়েছে এমন নানা কাহিনি বা মিথ, যা সমৃদ্ধ করেছে তাদের সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে।

কিন্তু কালের বিবর্তনে আদিবাসীদের জীবন আজ সংকটাপন্ন। নানা কারণে লুপ্ত হচ্ছে তারা, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি। একইসঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে তাদের বিশ্বাসের লোককথা বা মিথগুলো।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ২৯ এপ্রিল ২০২৪

© 2024, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button