‘বৈসাবি’ কি কোনও উৎসবের নাম?
বৈশাখ এলেই পাহাড়ে আদিবাসী উৎসব হিসেবে ‘বৈসাবি’ শব্দটির ব্যবহার খুব বেড়ে যায়। মূলধারার প্রায় সব গণমাধ্যমের নানা সংবাদে বৈসাবি শব্দটিকে আমরা দেখতে পাই। যেখানে এটিকে একটি আলাদা উৎসব হিসেবেই তুলে ধরা হয়। বৈসাবিকে উৎসব হিসেবে তুলে ধরার রেওয়াজটি চলছে বহুদিন। ফলে এখন সাধারণ পাঠকের কাছেই বৈসাবি একটি পাহাড়ি উৎসবের নাম। আসলেই কি তাই?
চৈত্র-বৈশাখে বাঙালির মতো আদিবাসী জাতির মানুষেরও সম্মিলন ঘটে নানা উৎসব ও আনুষ্ঠানিকতায়। এসব উৎসবগুলোই তাদের মিলনমেলা। উৎসবে দলগত নৃত্য, গান, বিশ্বাসের নানা আচার আর প্রাণখোলা আড্ডায় আদিবাসীরা ভুলে যায় হিংসা-বিদ্বেষের বিভেদটুকু। ফলে তাদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ আরও সুদৃঢ় হয়।
এ সময়ে চাকমা আদিবাসীরা বিজু, ত্রিপুরারা বৈসুক, মারমারা সাংগ্রাইং, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু, অহমিয়া আদিবাসীরা বিহু উৎসব পালন করে থাকে। এছাড়া অন্য আদিবাসীরাও নিজ নিজ নামে অভিহিত করে এ সময়ে তাদের উৎসবকে। কিন্তু কোনও আদিবাসী উৎসবের নাম ‘বৈসাবি’ নয়।
মূলত ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’ উৎসব থেকে ‘বৈ’, মারমাদের ‘সাংগ্রাইং’ থেকে ‘সা’, আর চাকমাদের ‘বিজু’ উৎসব থেকে ‘বি’ এভাবে তিনটি নামের আদ্যক্ষর এক করে হয়েছে ‘বৈ-সা-বি’। এটি আলাদা কোনও উৎসবের নাম নয়।
কিন্তু বৈসাবি শব্দটিকে উৎসব হিসেবে গণমাধ্যমে বহুল প্রচারের ফলে আলাদাভাবে ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমাসহ অন্যান্য জাতির উৎসবের নামটি প্রায় চাপা পড়ে যাচ্ছে। ফলে গণমাধ্যম কর্মীদের এ বিষয়ে আরও আন্তরিক থাকার কথা বলছেন গবেষকরা। বৈশাখে পাহাড়ের উৎসবগুলো সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তুলে আনা খানিকটা তথ্য তুলে ধরছি।
ত্রিপুরা আদিবাসীদের প্রধানতম উৎসব হলো বৈসুক। চৈত্র মাসের শেষের দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিনটিতে পালন করা হয় এই উৎসব। চৈত্রের শেষ দুই দিনের প্রথম দিন অর্থাৎ ২৯ চৈত্র ‘হারিবৈসু’ আর ৩০ চৈত্র বা শেষ দিনটিকে তারা বলে ‘বিসুমা বা বুইসুকমা’। আর পহেলা বৈশাখের দিনটিকে বলা হয় ‘বিসিকাতাল’।
‘হারিবৈসুর’ দিনটিতে বিশেষ শ্রদ্ধায় গবাদি-পশুপাখির পরিচর্যা করা হয়। চন্দন পানি দিয়ে গবাদি পশুদের স্নান করানোসহ তাদের দেওয়া হয় উন্নতমানের খাদ্য ও পানীয়। অতঃপর ফুলের মালা পরিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা ও ক্ষমা প্রার্থনা করে ত্রিপুরা।
ঝুঁড়িতে ধান নিয়ে মোরগ-মুরগিকেও ছিটিয়ে দেয়। এদিন বাড়িঘর নিম ও আমপাতা, দুর্বাঘাস ও ফুল দিয়ে সাজানো থাকে। কেননা ত্রিপুরা সমাজে নিম, আম, ডুমুর, বট ও অশ্বত্থ গাছের পাতাকে শান্তির প্রতীক, দুর্বাকে অমরত্বের প্রতীক, ফুলকে ভক্তির প্রতীক আর পান-সুপারিকে কল্যাণের প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়।
উৎসবের এ দিনে সৃষ্টিকর্তার কাছে মঙ্গল কামনায় ভোরে নদীর তীরে কাদামাটি ও বালুর দেবী তৈরি করে এ আদিবাসীরা। এটি ‘খুমকামুং’ পূজা। সন্ধ্যায় মৃত আত্মীয়-স্বজনদের আত্মার শান্তি কামনা করে মাঙ্গলিক প্রদীপ জ্বালিয়ে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয় তারা। একে ‘সিমতং’ পূজা বলে।
এ সময় যুবক-যুবতীরা সুন্দর পোশাক পরিধান করে ঢোলের বাজনায় মনের নানা ইচ্ছা নিয়ে কলা পাতা বা কাঁঠাল পাতার ঠোঙ্গায় তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। তখন আবেগ আপ্লুত হয় তাদের মন। হাজার হাজার প্রদীপ নদীর জলে ভাসতে থাকে। রাতের অন্ধকারে তা অপরূপ দেখায়। একদিনে গৃহিণীরা বিশেষ ধরনের পানীয় তৈরি করে।
চৈত্রের শেষ দিনে বিসুমা পর্বকে ত্রিপুরারা সংযম ও ত্যাগের পর্ব বলে। এই দিনে কেউ কায়িক পরিশ্রম করে না, মিথ্যা কথা বলেন না। সকল প্রকার খারাপ কাজ থেকেও বিরত থাকে। এ সময় মাটি কাটা, গাছ ও বাঁশ কাটা এবং প্রাণীবধ নিষেধ থাকে। বিশেষ ধরনের নিরামিষ বা ‘পাচন’ তরকারি খেয়ে ত্রিপুররা মঙ্গলের জন্য উপাসনা করে।
বিসিকাতাল পর্বে মূলত নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। এ সময় দৈহিক, মানসিক ও জাতির সামগ্রিক মঙ্গলের জন্য পূজা করে ত্রিপুরারা। এ দিনে প্রতিটি পরিবার আমিষ খাদ্যের আয়োজন করে। তাদের বিশ্বাস এই দিন কেউ খালি মুখে ফিরে গেলে সারাবছরের জন্য গৃহস্থের অমঙ্গল হয়।
ত্রিপুরাদের বৈসুক উৎসবে ঘরে ঘরে বিচিত্র ধরনের পিঠা আর মদ ও অন্যান্য পানীয় পান করানো হয়। উৎসব শুরু হলে ‘গরাইয়া’ নৃত্যর দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে নৃত্য পরিবশেন করে। এই আনন্দদায়ক লোকনৃত্যে ১৬ থেকে ৫০০ পর্যন্ত মানুষ অংশ নিতে পারে। ২২টি অসাধারণ মুদ্রা সৃষ্টি করা হয় নৃত্যে।
নৃত্যদলের একজনের কাঁধে বাঁধা শূলে থাকে একটি খাদি। ঘরের উঠোনে এ শূলটি বসানো হলে, ওই ঘরের মালিককে গরাইয়া দেবতার পূজা দিতে হয়। নৃত্য শেষে প্রতি বাড়িতেই শিল্পীরা সুর করে ওই গৃহস্থকে আশীর্বাদ করে। তখন সবাইকে মদ, মুরগির বাচ্চা ও চাল তুলে দেওয়া হয়। এভাবে প্রত্যেক বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা সামগ্রী দিয়ে গরাইয়া দেবতার পূজা করে ত্রিপুরারা।
মারমাদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ‘সাংগ্রাইং’। পৃথিবীতে সাংগ্রাং নামে এক দেবী মানুষের সৌভাগ্য আর কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসেন। তাই স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে দেবীর পা রাখার ক্ষণটি থেকেই শুরু হয় এ উৎসব— এমনটিই বিশ্বাস মারমাদের। ফলে যে ক’দিন দেবী পৃথিবীতে অবস্থান করবেন, সে ক’দিনই তারা নানা আনুষ্ঠানিকতা পালন করে।
এ আদিবাসীদের সাংগ্রাইং চলে তিনদিন। প্রথম দিনটিকে এরা বলে ‘পাইং ছোয়াইক’ অর্থ ‘ফুল তোলা’। এদিন মারমা যুবতীরা নানা ধরনের পাহাড়ি সুগন্ধি ফুল সংগ্রহ করে। বুদ্ধপূজার রাতে সে সব ফুল সাজিয়ে দলবেঁধে সবাই বৌদ্ধবিহারে গমন করে।
বুদ্ধমূর্তির বেদিতে ভক্তি সহকারে সেই ফুল রেখে তারা প্রার্থনা নিবেদন করে এবং নানা রঙের মোম ও ধূপকাঠি জ্বালিয়ে রাখে। যারা বিহারে যেতে পারে না, তারাও নিজ গৃহে রাখা বুদ্ধমূর্তির সামনে ফুলের অর্ঘ্য, মোম ও ধূপকাঠি জ্বালিয়ে প্রণাম ও প্রার্থনা করে। ওইদিন বিকালে বুদ্ধমূর্তি নিয়ে সকল বয়সী মারমারা সারিবদ্ধভাবে গ্রাম প্রদক্ষিণ করে। ওই রাতে মারমা যুবক-যুবতীরা না ঘুমিয়ে গান-বাজনায় ব্যস্ত থাকে। এ সময় তারা নানা পদের ও হরেক রকমের পিঠা-পায়েস তৈরি করে।
উৎসবের দ্বিতীয় দিনটি দেবীর আগমন দিবস। তাই ভোর থেকে রাত অবধি ঘরে ঘরে চলে প্রবীণ পূজা। তৃতীয় দিনটি দেবীর নির্গমন দিবস। এদিন ভোরে এরা মঙ্গলাচরণ, অষ্টশীল গ্রহণ ও পিণ্ডদান, বিকালে গোলাপ ও চন্দন মিশ্রিত জলে বুদ্ধ স্নান, সন্ধ্যায় প্রদীপ পূজা এবং রাতের আরতি দানের মধ্য দিয়ে উৎসবের সমাপ্তি ঘটায়।
এছাড়া মারমা সমাজে রিলংবোয়ে বা জলকেলি অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে। এটি যুবক-যুবতীদের মধ্যে সামাজিক ঐক্য, সম্প্রীতি, প্রেম-ভালোবাসায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। এ সময় পানি নিয়ে কোনও ঝগড়া বিবাদ করা যায় না। কৌণিক বা আড়াআড়িভাবে পানি নিক্ষেপ নিষেধ থাকে। অনুষ্ঠান চলাকালে কেউ কোনও অশোভন, অশালীন বা অশ্লীল আচরণও করতে পারে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে বৃহৎ জনগোষ্ঠী হচ্ছে চাকমারা। বিজু উৎসবের সঙ্গে তাই দুলে ওঠে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম। চাকমারা বিজু উৎসব পালন করে তিনদিন। বাংলাবর্ষের শেষ দিনটিকে এরা মূল বিজু, তার আগের দিনটিকে ফুল বিজু এবং নববর্ষের প্রথম দিনটিকে ‘গুজ্জেই পজ্জা’ দিন বলে।
ফুল বিজুর দিনে ছেলেমেয়েরা খুব ভোরে উঠেই বিভিন্ন ধরনের ফুল তুলে নিজ নিজ বাড়িতে আনে। অতঃপর সেগুলো দিয়ে বুদ্ধপূজা, গৃহ দেবতার পূজা করে থাকে। এ সময় ঘরবাড়ি ও আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফুলে ফুলে বাড়িঘর সাজানো হয়। গরু, মহিষ ইত্যাদির গলায়ও পরিয়ে দেওয়া হয় ফুলের মালা।
এ দিনে সবাই একত্রিত হয়ে শিকারে বের হয়। কেউ কেউ মাছ ধরতে যায় নদীতে। মেয়েরা নানা তরিতরকারি সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে পড়ে। বিকেলে গোয়ালঘরে, স্নান ঘাটে সুতালি বাতি বা মোম জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়।
মূল বিজুর দিন চাকমারা খুব ভোরে দলে দলে নদী, পাহাড়ি ছড়া বা জলাশয়ে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে পুরনো বছরের গ্লানি ভুলে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। মেয়েরা স্নান সেরে ফুল বিজুর দিনে সংগ্রহ করা প্রায় ২০ রকমের শাকসবজি দিয়ে রান্না করে ‘পাঁচন’ নামক এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার। এ সময় আগতদের নানা ধরনের খাদ্য ও প্রিয় পানীয় ‘জগরা’ বা ‘কাঞ্জি’ মদ দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।
তৃতীয় দিন বা নববর্ষের প্রথম দিন চাকমারা দলবেঁধে উপাসনালয়ে গিয়ে নতুন বছরের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে। যুবক-যুবতীরা মহানন্দে আকাশ প্রদীপ জ্বালায় এবং বাজি ফোটায়। মূল বিজুর দিনে নানা প্রকার পানীয় ও খাদ্যদ্রব্য খাওয়া হয়। তাই এর পরদিন বা নববর্ষের প্রথম দিনে চাকমারা বিশ্রাম নেয়। এ কারণেই এ দিনটিকে এরা ‘গুজ্জেই পজ্জা’র দিন অর্থাৎ শুয়ে থাকার দিন বলে।
যখন এ লেখা লিখছি তখন পাহাড়ে আতঙ্কের নানা খবর উঠে আসছে গণমাধ্যমগুলোতে। বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ব্যাংকের টাকা ও অস্ত্র লুট এবং ম্যানেজারকে অপহরণের ঘটনায় গোটা পার্বত্য অঞ্চল এখন অশান্ত।
নিরাপত্তার কারণে অনেক আদিবাসীই নিজের বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছে। বিগত কয়েক দশক ধরে পাহাড়ি-পাহাড়ি দ্বন্দ্ব, পাহাড়ি-বাঙালিদের রাজনৈতিক ইন্ধনে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলে।
এতে বাড়ছে হত্যা, অপহরণ ও ধর্ষণের মতো ঘটনাও। ফলে পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। তাই এবার বৈশাখে আদিবাসী উৎসবগুলো পালনে প্রয়োজন বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যার জন্য এগিয়ে আসতে হবে আদিবাসীসহ স্থানীয় প্রশাসনকেই।
নববর্ষকে ঘিরে আদিবাসী উৎসবগুলো পালিত হয়ে আসছে আবহমানকাল থেকেই। এই উৎসবে ঘটে তাদের বৃহৎ সম্মিলন। যা তাদের দলবদ্ধতা ও একতার প্রতীকও। তাই পাহাড়ে আমরা কোনও হত্যা চাই না। চাই স্বাধীন এ দেশে সব জাতির উৎসবগুলো পালিত হোক নির্ভয়ে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সকাল সন্ধ্যা ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৪ এপ্রিল ২০২৪
© 2024, https:.