অন্যরকম বঙ্গবন্ধু
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মতো উড়ে বেড়ায়। আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন ঐ রকমই নরম, ঐ রকমই সবুজ। প্রকৃৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, সৌন্দর্যই আমরা ভালোবাসি…বঙ্গবন্ধু
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের ছোট ছোট ঘটনা থেকে রাজনৈতিক শিক্ষা ও দর্শন খুঁজে নিতেন, সেটি মেনে চলার চেষ্টাও করতেন। তেমনি কয়েকটি জীবনমুখী ও শিক্ষামূলক ঘটনার কথা জানা যায় তার রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থে।
বাগান করতে পছন্দ করতেন বঙ্গবন্ধু। আগাছা পরিষ্কারের দিকে ছিল তার বিশেষ নজর। আগাছার মতো পরগাছা রাজনীতিবিদরাও রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর। এমন রাজনীতিবিদদের নিয়ে ভয়ও ছিল তার। এ প্রসঙ্গে কারাগারের রোজনামচায় (১১৭ পৃষ্ঠায়) তিনি উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘দুপুরের দিকে সূর্য মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতে শুরু করছে। রৌদ্র একটু উঠবে বলে মনে হয়। বৃষ্টি আর ভালো লাগছে না। একটা উপকার হয়েছে আমার দূর্বার বাগানটার। ছোট মাঠটা সবুজ হয়ে উঠেছে। সবুজ ঘাসগুলি বাতাসের তালে তালে নাচতে থাকে। চমৎকার লাগে, যেই আসে আমার বাগানের দিকে একবার না তাকিয়ে যেতে পারে না। বাজে গাছগুলো আমি নিজেই তুলে ফেলি। আগাছাগুলিকে আমার বড় ভয়, এগুলি না তুললে আসল গাছগুলি ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন আমাদের দেশের পরগাছা রাজনীতিবিদ যারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক তাদের ধ্বংস করে, এবং করতে চেষ্টা করে। তাই পরগাছাকে আমার বড় ভয়। আমি লেগেই থাকি। কুলাতে না পারলে আরও কয়েকজনকে ডেকে আনি। আজ বিকালে অনেকগুলি তুললাম।’
বন্ধুর সঙ্গে মানুষের বেইমানি করাটাকে মানতে পারতেন না বঙ্গবন্ধু। পশুর চেয়েও তারা অধম বলে মনে করতেন। জেলখানায় মুরগি ও পাখি পুষতেন। উদাহরণ তুলে ধরে (১১৮ পৃষ্ঠায়) তিনি লিখেছেন, ‘আমার মোরগটা আর দুইটা বাচ্চা আনন্দে বাগানে ঘুরে বেড়ায় আর ঘাস থেকে পোকা খায়। ছোট কবুতরের বাচ্চাটা দিনভর মোরগটার কাছে কাছে থাকে। ছোট মুরগির বাচ্চারা ওকে মারে, কিন্তু মোরগটা কিছুই বলে না। কাক যদি ওকে আক্রমণ করতে চায় তবে মোরগ কাকদের ধাওয়া করে। রাতে ওরা একসাথেই পাকের ঘরে থাকে। এই গভীর বন্ধুত্ব ওদের সাথে। এক সাথে থাকতে থাকতে একটা মহব্বত হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষ অনেক সময় বন্ধুদের সাথে বেইমানি করে। পশু কখনো বেইমানি করে না। তাই মাঝে মাঝে মনে হয় পশুরাও বোধ হয় মানুষের চেয়ে একদিক থেকে শ্রেষ্ঠ।’
কারাগারের দিনগুলিতে বঙ্গবন্ধুর বন্দি জীবনের বন্ধু বলতে গাছপালা, হলদে পাখি, চড়ুই পাখি আর কাকের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। এক জায়গায় (২২৭ পৃষ্ঠায়) লিখেছেন, ‘সিভিল ওয়ার্ডের সামনে ছোট একটা মাঠ আছে। সেখানে কয়েকটা আমগাছ আছে। ফুলের বাগান করেছি। জায়গাটা ছাড়তে ইচ্ছে হয় না…সকাল বেলা যখন ফুলের বাগানে বেড়াতে শুরু করি তখন রাতের কষ্ট ভুলে যাই। গাছতলায় চেয়ার পেতে বসে কাগজ অথবা বই পড়ি। ভোরের বাতাস আমার মন থেকে সকল দুঃখ মুছে নিয়ে যায়। আমার ঘরটার কাছের আমগাছটিতে রোজ ১০টা-১১টা সময় দুইটা হলদে পাখি আসে। ওদের খেলা আমি দেখি। ওদের আমি ভালোবেসে ফেলেছি বলে মনে হয়। ১৯৫৮ সালে দুইটা হলদে পাখি আসত। তাদের চেহারা আজও আমার মনে আছে। সেই দুইটা পাখির পরিবর্তে আর দুইটা পাখি আসে। পূর্বের দুইটার চেয়ে একটু ছোট মনে হয়। বড় ব্যথা পাব ওরা ফিরে না আসলে। পাখি দুইটা যে আমার কত বড় বন্ধু যারা কারাগারে একাকী বন্দি থাকেন নাই তারা বুঝতে পারবেন না। আমাকে তো একেবারে একলা রেখেছে। গাছপালা, হলদে পাখি, চড়ুই পাখি আর কাকই তো আমার বন্ধু এই নির্জন প্রকোষ্ঠে।’
বাঙালিকে বোঝার গভীরতম হৃদয় ছিল জাতির পিতার। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর এক জায়গায় (২১৪ পৃষ্ঠায়) তিনি লিখেছেন ঠিক এভাবে, ‘প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মতো উড়ে বেড়ায়। আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন ঐ রকমই নরম, ঐ রকমই সবুজ। প্রকৃৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, সৌন্দর্যই আমরা ভালোবাসি।’
বাঙালির চরিত্রের নিখুঁত ব্যাখ্যাও করেছেন আরেক জায়গায় (৪৭ পৃষ্ঠায়) “আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো আমরা মুসলমান, আর একটা হলো আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধ হয় দুনিয়ার কোনো ভাষাতেই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষাতেই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজেকে এরা চেনে না, আর যত দিন চিনবে না এবং বুঝবে না, ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।”
ভাগ্যকে মেনে নেওয়া বাঙালির সহজাত স্বভাব। এ প্রসঙ্গে কারাগারের রোজনামচার তিনি (১১০ পৃষ্ঠায়) বলেছেন‘এই দেশের হতভাগা লোকগুলি খোদাকে দোষ দিয়ে চুপ করে থাকে। ফসল নষ্ট হয়েছে, বলে আল্লা দেয় নাই, না খেয়ে আছে, বলে কিসমতে নাই। ছেলেমেয়ে বিনা-চিকিৎসায় মারা যায়, বলে সময় হয়ে গেছে বাঁচবে কেমন করে! আল্লা মানুষকে এত দিয়েও বদনাম নিয়ে চলেছে। বন্যা তো বন্ধ করা যায়, দুনিয়ার বহু দেশে করেছে। চীন দেশে বৎসরে বৎসরে বন্যায় লক্ষ লক্ষ একর জমি নষ্ট হতো। সে বন্যা তারা বন্ধ করে দিয়েছে। হাজার কোটি টাকা খরচ করে ক্রুগ মিশনের মহাপরিকল্পনা কার্যকর করলে, বন্যা হবার সম্ভাবনা থাকে না। এমনকি বন্যা হলেও, ফসল নষ্ট করতে পারবে না। এ কথা কি করে এদের বোঝাব! ডাক্তারের অভাবে, ওষুদের অভাবে, মানুষ অকালে মরে যায় তবুও বলবে সময় হয়ে গেছে। আল্লা তো অল্প বয়সে মরবার জন্য জন্ম দেয় নাই। শোষক শ্রেণি এদের সমস্ত সম্পদ শোষণ করে নিয়ে এদের পথের ভিখারি করে, না খাওয়াইয়া মারতেছে। না খেতে খেতে শুকায়ে মরছে, শেষ পর্যন্ত না খাওয়ার ফলে বা অখাদ্য খাওয়ার ফলে কোনো একটি ব্যারাম হয়ে মরছে, বলে কিনা আল্লা ডাক দিয়েছে আর রাখবে কে?’
এমন বাঙালিকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভালোবেসেছিলেন হৃদয় উজাড় করে। তার সমগ্র জীবনের স্বপ্ন ছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে আর তার পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যা করায় রাষ্ট্র ও সমাজের অগ্রগতিতে যে শূন্যতা সৃষ্টি ও মুক্তিযুদ্ধের অর্জন ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল তা আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য এক কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে আছে। ব্যক্তি মুজিবের মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু তার আদর্শের মৃত্যু নেই। তাই অনন্তকাল অবধি বঙ্গবন্ধুর নানা গুণ ও আদর্শকে জানতে হবে। প্রজন্মের কাছে এই মহান নেতাকে তুলে ধরতে হবে সর্বজনীনভাবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৬ আগস্ট ২০২২
© 2022, https:.