এই কি দায়িত্বশীলতার পুরস্কার
অবশেষে অনেকের মতো সরকারের একজন মন্ত্রীও ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলা নিছক চুরির ঘটনায় হয়নি বলে উল্লেখ করলেন। গত মঙ্গলবার আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সভা শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়ে বলেন, ‘ওয়াহিদার ওপর হামলার ঘটনা আরও তদন্তের জন্য গোয়েন্দা সংস্থাকে আমরা নির্দেশ দিয়েছি। এর পেছনে কী রহস্য আছে, গডফাদাররা কারা, সেগুলো দেখার জন্য বলা হয়েছে।’ মন্ত্রীর এমন মনোভাব আমাদের আশাবাদ জাগায়।
কিন্তু ইউএনওর ওপর হামলার মতো স্পর্শকাতর ঘটনাটিকে তাড়াহুড়ো করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন চুরির ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল? সে বিষয়েও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি এই নির্মম ঘটনাকে ঘিরে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলায় সরকারদলীয় যেসব রাজনৈতিক নেতাকর্মীর নাম গণমাধ্যমে এসেছে তাদের কৃতকর্মের অনুসন্ধানে ওই দলের পক্ষ থেকেও একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করা যৌক্তিক ছিল। যেটি হওয়ার খবর আমরা এখনো পাইনি।
যখন লিখছি, তখন ইউএনও ওয়াহিদা খানমের শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তার প্যারালাইজড হওয়া ডানপাশ স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ফিরে পাবে কি না, সেটি নিশ্চিত করতে পারেননি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এ ঘটনায় তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী শেখের ঘাড়ে আঘাত পাওয়ায় স্পাইনাল কর্ডে আঘাতটি গুরুতর হয়। ফলে তার দুই হাত কিছুটা সচল থাকলেও অবশ হয়ে গেছে কোমরের নিচ থেকে পা পর্যন্ত। একজন মুক্তিযোদ্ধা কি কখনো ভেবেছেন এই স্বাধীন দেশে তাকে ও তার মেয়েকে এমন রক্তাক্ত ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে!
ওয়াহিদা খানমের ছোট্ট একটি সন্তান রয়েছে। ওই শিশু কী পরিমাণ মানসিক ট্রমার ভেতর রয়েছে তা কি আমরা ভেবে দেখেছি। তার মায়ের অপরাধ কী ছিল? বড় হয়ে শিশুটি যদি এমন প্রশ্ন তোলে তখন রাষ্ট্র বা সরকার কি পারবে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে? সততা ও দায়িত্বশীলতার পুরস্কার কি এ দেশে শুধুই রক্তাক্ত হওয়া। রাষ্ট্র হয়তো ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঠেকাতে প্রস্তুতি নেবে। কিন্তু ওয়াহিদা খানমের স্বাভাবিক জীবন তো ফিরিয়ে দিতে পারবে না!
ওয়াহিদা খানমের ওপর কেন এই হামলা? গণমাধ্যমের সংবাদ বলছে, বালুমহাল, খাসজমি দখল, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজিতে নানা সময়ে বাধা ও মতের অমিল ঘটায় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এমনটা মনে করছেন এলাকাবাসীও। ঘোড়াঘাট অঞ্চলে খাসজমি দখলের কর্মযজ্ঞ চলে। যে ক্ষমতাবান, পেশিশক্তির বলে সে-ই ওই সব জমি দখলে নেন। উপজেলার কলোনিপাড়ায় বিশাল অংশের খাসজমি দখলে নিতে চেয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান ও ঘোড়াঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানম নিয়মকানুন দেখিয়ে আপত্তি তোলেন। এলাকায় বালুমহাল, খাসজমি দখল, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজি জাহাঙ্গীর গ্রুপকে দিয়ে এসব অপকর্ম করাতেন প্রভাবশালীরা। এ ছাড়া অন্যায় আবদার না রাখায় ইউএনওর ওপর রুষ্ট ছিলেন কেউ কেউ।
হামলার ঘটনায় যাদের এখন পর্যন্ত আটক দেখানো হয়েছে তার মধ্যে নৈশপ্রহরী নাহিদ হাসান পলাশ বাদে সবার নামেই আছে একাধিক মামলা। মাদকের ব্যবসা, মাদক সেবন, জমি দখল করার অভিযোগ। আছে চাঁদাবাজি, ত্রাণ চুরি ও সাধারণ মানুষকে মারধরের অভিযোগও। এ ছাড়া বালুমহাল নিয়েও ইউএনওর সঙ্গে আটক ব্যক্তিদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছিল বলে গণমাধ্যমে সংবাদ এসেছে। এ ছাড়া ঘোড়াঘাট উপজেলার রানীগঞ্জ বাজার এলাকায় নুনদহ ঘাটে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করে আসছিলেন সিংড়া ইউনিয়নের যুবলীগ সভাপতি। সেখানে ইউএনও ওয়াহিদা খানম বেশ কিছুদিন আগে বালু উত্তোলনের সরঞ্জাম পুড়িয়ে দেন। আবার ১৪ মে ইউএনওর কাছে মুক্তিযোদ্ধা সায়েদ আলীর জামাতা আবিদুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম ও মাসুদ রানার বিরুদ্ধে জমি দখল ও চাঁদা দাবি করার অভিযোগ করেন। বিষয়টি ইউএনও গুরুত্বের সঙ্গে নেন এবং অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের বিষয়ে তৎপরতা চালান। এলাকাবাসীর ধারণা, এসব কারণেই একটি চক্রের পরিকল্পনায় যুবলীগের জাহাঙ্গীর আলম ও আসাদুল ইসলাম হামলায় অংশ নেন। যুবলীগ এরই মধ্যে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করলেও তারা কীভাবে এত দিন দলের আশ্রয়ে ছিলেন, তা নিয়েও রয়েছে নানা আলোচনা।
মাঠপর্যায়ের একজন সরকারি কর্মকর্তার সরকারি বাসভবনে রাতের আঁধারে যেভাবে হামলার ঘটনা ঘটেছে, তা নজিরবিহীন। জঘন্য ও নৃশংসভাবে একজন ইউএনওর প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছে; যা কোনোভাবেই চুরি বা ডাকাতির ঘটনা ছিল না। আমরা মনে করি গণমাধ্যমে উঠে আসা এসব ঘটনাকেও তদন্তে নিয়ে আসা বিশেষ প্রয়োজন। ইউএনও ওয়াহিদা খানম তার উপজেলায় করোনাকালে চমৎকার সার্ভিস দিয়েছেন। মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন, কড়াকড়িভাবে লকডাউন পালন করে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন, অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমেও সব মহলের কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। কাজের মাধ্যমে নিজেকে একজন সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে প্রমাণ করেছেন তিনি। দায়িত্বশীলদের ওপর এমন আঘাত ভালো কাজে অনেকের মনোবলই ভেঙে দিতে পারে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা।
কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে প্রান্তিক পর্যায়ে কাজ করে থাকেন ইউএনওরা। উপজেলার আইনশৃঙ্খলা কমিটিসহ প্রায় প্রতিটি বিভাগের সব কমিটির সভাপতি তিনি। এ ছাড়া মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা থেকে শুরু করে আইনের প্রতিটি বিষয় দেখার দায়িত্ব থাকে তার। কোথাও আইনের ব্যত্যয় করে যদি কিছু আবদার করা হয়, সেটি না হলেই তখন অনেকে ইউএনওদের বিরাগভাজন হন। কিন্তু ইউএনও ওয়াহিদা খানমের বাড়িতে ঢুকে হামলার ঘটনায় সারা দেশে সরকারের সব দপ্তরের দায়িত্বশীলদের নিরাপত্তাহীনতাকেই স্পষ্ট করেছে।
শুধু ইউএনওরাই নন, স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও চক্রের মাধ্যমে নানাভাবে নিপীড়ন-নিগ্রহের শিকার হয়ে থাকেন সারা দেশের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা। কিছু ঘটনায় মামলা হলেও তার বিচারকার্য চলে মন্থর গতিতে। ফলে অপরাধীরা আরেকটি ঘটনা ঘটানোর সাহস পায়। তাই এ ধরনের ঘটনার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করাও বিশেষ প্রয়োজন।
ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার পর বেশ কিছু সিদ্ধান্ত সরকার খুব দ্রুত নিয়েছে। সারা দেশে ইউএনওদের নিরাপত্তায় অস্ত্রধারী আনসার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। উপজেলা কমপ্লেক্সের নিরাপত্তা জোরদারেরও পরিকল্পনা নিয়েছে। সরকারের এ উদ্যোগ সরকারি কাজে নিযোজিত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা পরিবেশ তৈরিতে সামান্য হলেও ভূমিকা রাখবে। কিন্তু নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সরকারদলীয় একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতাকর্মীর অবৈধ বালু উত্তোলন, খাসজমি দখল, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজির মতো অবৈধ কাজের লাগাম এখনই টেনে ধরতে না পারলে সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হবে। তাই সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনের নিরাপত্তাসহ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতসহ ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার নেপথ্যের ঘটনা দ্রুত উন্মোচিত ও জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে রাষ্ট্র দায়িত্বশীলদের পাশে থাকবে এমনটাই আমাদের আশা।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০
© 2020, https:.