আদিবাসী নারী। কথাটি শুনলেই মনে পড়ে যায় রাসিমণি হাজং, কুমুদিনী হাজং ও কল্পনা চাকমার কথা। প্রথম দুই নারী হাজং বিদ্রোহের বিপ্লবী। কেন তারা স্মরণীয়? তা জানতে বেশ পেছন ফিরে তাকাতে হবে। ১৯৪৬ সালের কথা। সময়টা টংক বিরোধী আন্দোলনের। সুসং দুর্গাপুরের বহেরাতলী গ্রামে ঘটেছিল রক্তাক্ত এক ঘটনা। গ্রামটি সোমেশ্বরী নদীর পশ্চিম পাড়ে, গারো পাহাড়ের একেবারেই পাদদেশে। হাজং ও গারোদের বসবাস ছিল গ্রামজুড়ে। দুর্গাপুরের অপর পাড়ে অর্থাৎ বিরিশিরিতে তখন বসানো হয় পুলিশের একটি সশস্ত্র ক্যাম্প। গুলি চালানোর অর্ডার দিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটও থাকেন সেখানে। উদ্দেশ্য টংক বিরোধী আন্দোলনকারীদের দমন করা। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি। দুপুর বেলা। পঁচিশ জন পুলিশ বহেরাতলী গ্রামে প্রবেশ করে। এ সময় গ্রাম থেকে তারা কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিয়ে যায়। ওই সময় বহেরাতলীর পাশর্^বর্তী গ্রামে রাসিমণির সশস্ত্র প্রচার দল বিশ্রাম নিচ্ছিল। কুমুদিনীর আর্তচিৎকারে রাসিমণির অন্তরে জ¦লে ওঠে প্রতিহিংসার আগুন। তিনি নিঃশব্দে তুলে নেন তার রক্তপতাকা আর চিরসঙ্গী হাতিয়ার বড় দা-খানি।
পঁয়ত্রিশজন নিয়ে রাসিমণি কুমুদিনীকে বর্বর পুলিশদের অত্যাচার থেকে বাঁচাবার জন্য ছুটে আসেন। পুলিশ দলও তাদের দিকে গুলি চালাতে থাকে। সবার সামনে থেকে প্রাণপণে দা চালান রাসিমণি। যে পুলিশটি কুমুদিনীর ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছিল, রাসিমণি তাকে খুঁজে পেয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে দায়ের এক কোপ বসিয়ে দেন। সে আঘাতেই পুলিশের মাথাটি তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বীরমাতার ভয়ংকর রূপ দেখে পুলিশ দল উন্মত্তের মতো গুলিবর্ষণ করতে থাকে। দশটি বুলেটে রাসিমণির দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। লড়াই করতে করতেই তার প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এভাবে টংকবিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ হন রাসিমণি। আর কুমুদিনী হাজং আজও বেঁচে আছেন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন কল্পনা চাকমা। নব্বইয়ের দশকে নারী অধিকার আদায় এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পার্বত্য চট্টগ্রামে হিল উইমেন্স ফেডারেশন এক নজির সৃষ্টি করেছিল। ১৯৯৬ সালের ১১ জুন। রাতে অপহরণ করা হয় কল্পনা চাকমাকে। পরবর্তী সময়ে কল্পনা চাকমার অপহরণের বিরুদ্ধে হিল উইমেন্স ফেডারেশন দেশ ও বিদেশে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ফলে ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করলেও কল্পনা চাকমার খোঁজ আজও দিতে পারেনি সরকার।
সামগ্রিকভাবে নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন অনেক। কিন্তু আদিবাসী নারীদের উন্নয়ন এবং তাদের প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অগ্রগতি তেমন ঘটেনি। বরং নানাভাবে, নানা রূপে তাদের প্রতি নির্যাতন বাড়ছেই। একটি বেসরকারি সংস্থার দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ৩৬৪ জন আদিবাসী নারীর প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। যার মধ্যে ১০৬ জন শারীরিক নিপীড়নের শিকার, ১০০ জন আদিবাসী নারী ধর্ষণের শিকার আর ৬৬ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৭ সালের শুধু জানুয়ারি মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১০ জন। এর মধ্যে কয়েকজনকে ধর্ষণের পর হত্যাও করা হয়েছে। যার মধ্যে সবিতা চাকমা, সুজাতা চাকমা, ছবি মারমা আর তুমাচিং মারমার নাম এসেছে গণমাধ্যমে। অন্যদিকে, সমতলের আদিবাসীরা নানাভাবে স্থানীয় বাঙালিদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিয়েও তারা বঞ্চিত হন ন্যায়বিচার থেকে। ফলে নানা হুমকিতে থাকতে হয় পরিবারগুলোকে। গারো নারীরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছেন বিউটি পার্লার, গার্মেন্ট ও বিদেশিদের বাড়িতে। মালিক দ্বারা হয়রানি ছাড়াও তারা ন্যায্য মজুরি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া বাঙালিদের একটি চক্র নানা প্রলোভনে বা জোর করে বিয়ের মাধ্যমে গারো নারীদের ধর্মান্তরিত করেও লুফে নেয় তাদের সহায়-সম্পত্তি।
আদিবাসী নারীদের নির্যাতন বা যৌন নির্যাতন বৃদ্ধির মূল কারণ বিচারহীনতা। প্রশাসন, রাজনীতি ও বিচার ব্যবস্থার পক্ষপাতিত্বের কারণে আদিবাসী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচার পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া আদিবাসীদের দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থাও যৌন সহিংসতার সুযোগ তৈরি করে দেয়। ফলে আদিবাসী নারীদের ন্যূনতম অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়নি এখনো। অথচ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি ছাড়াও অংশ নিয়েছিলেন আদিবাসী নারীরা। দুর্গাপুরের লতিকা এন মারাক, সন্ধ্যা ম্রি, ভিবা সাংমা, খাসিয়া রমণী কাঁকন বিবি, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের তেরেসা মাহাতো, টেকনাফের রাখাইন নারী প্রিনছা খে-সহ আরও নারী মুক্তিযোদ্ধার নাম উল্লেখ করা যায়। মুক্তিযুদ্ধে সাতচল্লিশ বছর পরও আদিবাসী নারী মুক্তিযোদ্ধারাও কি পেয়েছেন তাদের উপযুক্ত সম্মানটুকু?
৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘সবাই মিলে ভাবো, নতুন কিছু করো, নারী-পুরুষ সমতার নতুন বিশ্ব গড়ো’। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আদিবাসী নারীদের অধিকার ও মর্যাদা বাস্তবে কতটুকু প্রতিষ্ঠা পেয়েছে? তাদের ক্ষমতায়ন ও মানবতার উন্নয়নই-বা কতটুকু ঘটেছে? আদিবাসী সমাজে পর্দা করার প্রথা নেই। সামাজিকভাবে নেই নারীদের কাজের ওপর কোনো বিধিনিষেধ। ফলে তুলনামূলকভাবে তারা অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে। আশি শতাংশ আদিবাসী নারী-পুরুষের মতো বাইরে কাজ করে পরিবারে অর্থের সংস্থান করেন। কিন্তু তবুও সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রশ্নে অধিকাংশ আদিবাসী সমাজে নারীরা বঞ্চিত ও অবহেলিত। বাবা-মায়ের সম্পত্তির ভাগ তারা পায় না। জাতীয় নারী নীতিতেও আদিবাসী নারীদের এ ইস্যুটি উপেক্ষিত হয়েছে। অথচ ১৯৯৭ সালে প্রস্তাবিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার ৭.২ ধারায় উত্তরাধিকারসহ ভূমির ওপর নারী পূর্ণ ও সমান সুযোগদানের জন্য নতুন আইন প্রণয়নের কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু তা হয়নি অদ্যাবধি।
মর্যাদা ও ক্ষমতায়নে আদিবাসী নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে। শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আদিবাসী নারীরা প্রায় অনুপস্থিত। যদিও বর্তমান সরকার জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে একজন আদিবাসী নারীকে নির্বাচিত করেছে। আবার পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন সার্কেলের প্রধানরা পুরুষ এবং উত্তরাধিকার সূত্রে কেবল পুরুষরাই যোগ্য হবেন। এমন নিয়ম এখনো বলবৎ রয়েছে। এছাড়া হেডম্যান ও গ্রামপ্রধান পদগুলোও পুরুষকেন্দ্রিক রয়ে গেছে। এই সব ক্ষেত্রে আদিবাসী নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় সামাজিকভাবে আদিবাসী নারীদের প্রতি নির্যাতন ও বৈষম্য বেড়েছে বহু গুণ। নানা কারণে মানুষের প্রতি নানা বৈষম্য রয়ে গেছে। এই বৈষম্য থাকা অসাংবিধানিক। যা বিলোপ করতে আইনপ্রণয়ন একান্ত প্রয়োজন। ৮ মার্চ ১৯১০। নিউ ইয়র্কের সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকদের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার প্রতি সম্মান জানাতেই আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। সব ক্ষেত্রে নারীর অর্জনকে মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে এদিনে নারীরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসকে স্মরণ করেন এবং ভবিষ্যতের পথপরিক্রমা নির্ধারণ করেন। তাই আমরাও চাই স্বাধীন এ দেশে আদিবাসী নারীদের প্রতি সকল ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতা বন্ধ হোক। তাদের অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠা পাক। এর উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। কেননা আদিবাসী নারীদের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত না হলে সামগ্রিকভাবে নারী উন্নয়ন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েই থাকবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৯ মার্চ ২০১৯
© 2019, https:.