রাজাকার কখনও মুক্তিযোদ্ধার বন্ধু হতে পারে না
একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ টেনে তোলার দায়িত্ব এসে পরে বঙ্গবন্ধুর ওপর। মানুষ যেন না খেয়ে না মরে– এটার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার পাশে থাকেনি অনেক মুক্তিযোদ্ধাও। জাসদ তৈরি হল। তারা তার বিরুদ্ধাচারণ করতে থাকল। সিরাজ সিকদারের কার্যকলাপও বঙ্গবন্ধুকে বিপাকে ফেলেছিল। এসবের সুযোগ নেয় স্বাধীনতাবিরোধীরা। বঙ্গবন্ধু যাদের বিশ্বাস করেছিলেন তারাই তার খুনিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে এরাই ইতিহাসের কালো অধ্যায় তৈরি করেছে। ফলে দেশ তখন চলতে থাকে উল্টো পথে।…. যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কালাম।
“ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত আছিলাম। ফুটবলে ছিলাম ওস্তাদ। মিডেলে খেলতাম। বল পাইলেই গোল। জেলা লেভেল পর্যন্ত ম্যাচ খেলছি। আব্বা পড়তে বসাইত বিকালে। আমি পায়খানায় যাওয়ার নাম কইরাই মাঠের দিকে ছুটতাম।
“একবার পরানপুর মাঠে খেলা চলছে। গায়ের জোর নিয়া এক ছেলে দেয় শট। বল সইরা পুরা হিটটা আইসা লাগে আমার ডান পায়ে। আমি ছিটকে পড়ি। মাটিত পইড়াই জ্ঞান হারাই। ওইদিন মনে হইছিল বাঁচমু না! জ্ঞান ছিল না বিশ মিনিট। এরপরই খেলা বন্ধ রাখি।
“আমগো মজা ছিল আমের সিজনে। দুপুরবেলা চলত অভিযান। কারও গাছে ভালো আম দেখলেই রশিদকে নিয়া ফল নামাইতাম। নিজেগো গাছ ছিল অনেক। তবু অন্যের গাছের আম পাড়াতেই আনন্দ ছিল অন্যরকম। একবার বারেকের বাগানের আম পাড়তে গিয়া ধরা খাই। তাড়া খাইয়া তো আমরা দে ছুট। তবু রক্ষা পাই না। আব্বার কাছে বিচার আসে। শাস্তি দেন তিনি। হাতের মধ্যে গোটা বিশেক কঞ্চির বাড়ি। আঙুলগুলা তহন ফুইলা কলাগাছ হইয়া যাইত। কিন্তু তবু আমগো আম পাড়া বন্ধ হইত না।
“ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কটা তহন অন্যরকম ছিল। আক্কাস মাস্টার বাংলা, আজহার মাস্টার অংক আর মান্দার স্যার ইংরেজি পড়াইতেন। তারা আদর করতেন খুব। কিন্তু পড়া না পারলে হয় বেঞ্চের নিচে মাথা, না হয় বেঞ্চের ওপর দাঁড়ায়া থাকতে হইত। স্কুলে থাকতেই বন্ধুরা লুকায়া কুম্বু বিড়ি টানত। দূরে কোনো আড়ালে দাঁড়াইয়া বিড়ি টানতে হইত। বড় কাউকে দেখলেই ভয় পাইতাম। এহন তো ওইদিন নাই। বিড়ি টানা এহন কোনো ব্যাপার না। বড়গো সামনে বিড়ি টানলেই যেন ছাত্ররা স্মার্ট হইয়া যায়।”
শৈশবের স্মৃতি এভাবেই বলছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. মোস্তফা কামাল।
কছির উদ্দিন মন্ডল ও রহিমা বেগমের তৃতীয় সন্তান মোস্তফা কামাল। বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার সোনাপুর গ্রামে। তাঁর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি সোনাপুর প্রাইমারি স্কুলে। পঞ্চম শ্রেণি পাসের পর তিনি ভর্তি হন পরানপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ওই স্কুলেরই ক্লাস টেনের ছাত্র।
মোস্তফা কামালের পরিবার ছিল আওয়ামী আদর্শে উজ্জীবিত। বড় ভাই সোহরাব উদ্দিন মন্ডল ওই সময় কৃষক লীগ করতেন। বড়দের আলোচনা, রেডিও আর ‘করতোয়া’ পত্রিকার খবর থেকে জেনে যেতেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি নানা বৈষম্য।
তাঁর ভাষায়:
“যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান নেভি, আর্মি ও পুলিশের চাকরিতে বড় কোনো পোস্ট কোনো বাঙালিকে দেওয়া হত না। পাট বিক্রির সিংহভাগ টাকা চলে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে। কিন্তু বৈষম্য নিয়ে মানুষ তখনও ক্লিয়ার ছিল না। ছয় দফা আন্দোলনের পর বৈষম্যের প্রতি জনমত তৈরি হতে থাকে। নওগাঁয় মুসলিম লীগের লোক ছিল বেশি। ধর্মীয় গোঁড়ামিটাও তাই বেশি ছিল। এখনও আমার ইউনিয়নে জামায়াতে ইসলামের প্রার্থী চেয়ারম্যান হইছে। তহন ওখানে আওয়ামী লীগ করত মোজাহার, বিপলু বাবু, আমিনুর প্রমুখ।”
’৭০-এর নির্বাচনে মোস্তফা কামালদের এলাকায় এমপিএ হন ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক (বর্তমান পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী)। অপজিশনে ছিলেন মুসলিম লীগের আজাদ। নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের পক্ষে কামালরা পোস্টার লাগাতেন। স্কুল ছুটি হলেই কণ্ঠ আকাশে তুলে মিছিলে স্লোগান দিতেন: ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’, ‘নৌকায় ভোট দাও’, ‘ভোট ও ভাতের অধিকার চাই।’
বাকি ইতিহাস শুনি মোস্তফা কামালের জবানিতে:
“নির্বাচনের পর আমরা ধরেই নিছি ওরা ক্ষমতা দিব না। তহন আন্দোলন শুরু হইল। ৭ মার্চ ১৯৭১। শেখ মুজিব ভাষণ দেয় রেসকোর্স ময়দানে। রেডিওতে শোনা ওই ভাষণ আমার কাছে ভয়াল মনে হইছে। বঙ্গবন্ধু বললেন: ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি…।’
“তার অর্থ তিনি আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন তিনি থাকবেন না বা কিছু একটা ঘটবে। এটা ছিল ভয়াল বিষয়। তিনি আরও বললেন: ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম…।’
“তার মানে যা কিছুই ঘটুক না কেন ভবিষৎ নির্দেশনাও তিনি দিয়ে দিলেন। এই কথাগুলা তহন আমগো বুঝতে হইছে। ধারণা করছি স্বাধীনতা এমনি এমনি আসব না। যুদ্ধের জন্য তৈয়ার হতে হইব।”
https://www.youtube.com/watch?v=creJFK4Erxw
(যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. মোস্তফা কামালের কথা শুনতে ক্লিক করুন ওপরের লিংকে)
২৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় শুরু হয় গণহত্যা। নওগাঁ টাউনে আর্মি আসে ৩০ মার্চের পর। ওরা শহরে ক্যাম্প করে আশপাশের থানাগুলোতে গণহত্যা চালাতে থাকে। ওদের সহযোগিতা করে শান্তি কমিটির লোকেরা। মান্দায় শান্তি কমিটির বড় নেতা ছিলেন খলিলুর রহমান ও মাজেদ। পরানপুরে রাজাকার ছিল বেশি। তাদের সহযোগিতায় মনহরপুরে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে ৩৯ জনকে। পাকুরায় ওরা একসঙ্গে নির্মমভাবে মারে ৪৮ জনকে। এসব ঘটনা কামালের মনে ঝড় তোলে।
তিনি বলেন:
“বাবু বাজারে আমার ফুপাকে ওরা গুলি করে মেরে ফেলে। আমগো গ্রামও আক্রমণ করছে কয়েকবার। তহন বাড়ির পাশের পুকুরে লুকিয়ে ছিলাম। তহন ডুব দিয়া চোঙ্গা দিয়ে নিঃশাস নিছি বহু কষ্টে। কিন্তু এইভাবে আর কতদিন? মাকে বলেছিলাম: ‘মনে হয় থাকা যাবে না, মা।’
“মা বলেন: ‘না বাবা, কোথাও যাসনে বাপ।’
“অনেককে বলেছি: চলেন যুদ্ধে যাই। সবাই বলে আরেকটু দেহি। সারা দেন তহন আনিসার রহমান চাচা। একদিন কৌটায় রাখা মায়ের একটা গহনা চুরি করি। ওইটা বিক্রি করে পাই ষাট টাকা। তা নিয়েই এক রাতে বাড়ি ছাড়ি দেশের টানে।”
ট্রেনিং নিলেন কোথায়?
“জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। বর্ডার এলাকায় তহন রাজাকার আর শান্তি কমিটির লোকেরা টহল দিচ্ছে। ওগো চোখ ফাঁকি দিয়ে সুরিপুকুর হয়ে চলে যাই ভারতের নস্করহাটে। সেখান থেকে ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক একটা চিঠি লিখে আমাদের পাঠান মাহাতাব সাহেবের কাছে, গঙ্গারামপুর ইয়ুথ ক্যাম্পে। পরে তরঙ্গপুরে মেডিকেল চেকআপ শেষে সিল পড়ে বুকে। অতঃপর ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিলিগুড়ির পানিঘাটায়। থ্রি নট থ্রি, মার্ক ফোর, এসএলআর, এলএমজি, থার্টি সিক্স হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ প্রভৃতি শেখানো হয় ট্রেনিংয়ে। ব্র্যাভো কোম্পানিতে ২১ দিনের ট্রেনিং হয় আমাদের। এফ এফ (ফ্রিডম ফাইটার) নং ৫২৫৪।”
ট্রেনিং শেষে মোস্তফা কামালদের অস্ত্র দেওয়া হয় তরঙ্গপুর থেকে। অতঃপর ৩২ জনের প্লাটুন করে পাঠানো হয় রণক্ষেত্রে। প্লাটুনের কমান্ড করতেন বগুড়ার রফিকুল ইসলাম। তারা সম্মুখ যুদ্ধ করেন ৭ নং সেক্টরের মেহেদীপুর, আরগাড়া, ধোপরাসহ নবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়। পেছন থেকে সহযোগিতা করত ভারতীয় আর্মি। রেকি পেট্রোল করে আসলেই অপারেশনের প্লানিং হত। এরপর আবারও সার্ভে চলত। অপারেশন করে তারা আবার ফিরে আসতেন মেহেদীপুর ক্যাম্পে।
মোস্তফা কামাল যুদ্ধ করেছেন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। খুব কাছ থেকে দেখেছেন এই বীরকে। তাঁর স্মৃতিচারণ করে মোস্তফা কামাল বলেন:
“খুবই সাহসী ছিলেন তিনি। আমাদের প্রশ্ন করতেন: ‘তোমার দেশ কোথায়? কেউ বলত রাজশাহী, কেউ খুলনা, রংপুর।
“তিনি বলতেন: ‘বাড়িতে যাওয়ার কিন্তু পথ নাই! এখন কি করতে হবে– টু ডু অর ডাই। মারতে হবে না হয় মরতে হবে। তোমরা প্রস্তুত আছো?
“আমরা বলতাম ‘ইয়েস স্যার’।
“রণক্ষেত্রে বাতাসের সঙ্গে কথা বলার নির্দেশ দিতেন তিনি। বলতেন:‘সাইল্যান্স থাক।
কোনো শব্দ, কোথা থেকে আসছে নজরে রাখ। বিড়ি খাইও না। রাতের বেলা বিড়ির আগুন তোমার জীবন নিবে। অনেক দূর থেকে তুমি শত্রুর টার্গেটে পড়ে যাবে।’
“অপারেশনের ‘পাসওয়ার্ড’ বলে দিতেন। পাসওয়ার্ড ছিল ‘নদী’, ‘জল’, ‘পানি’, ‘আকাশ’, ‘মাটি’ প্রভৃতি। অপারেশন ভালো হলেই ঘাড়ে হাত রেখে বলতেন: ‘সাবাস’।
“বলতেন: ‘তোমার, আমার বাড়ি যাইতে হবে। ছেলেমেয়ে, মা-বাবাকে বাঁচাতে হবে। মনে রেখ যুদ্ধ করেই ওদের রক্ষা করতে হবে।’
“তাঁর মৃত্যুর সংবাদে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। একাত্তরে এমন অনেক বীরকেই হারিয়েছি আমরা।”
এক অপারেশনে মারত্মকভাবে রক্তাক্ত হন এই সূর্যসন্তান। পাকিস্তানি সেনাদের সেলের স্প্লিন্টার তাঁর বাম চোখের নিচে বিদ্ধ হয়। ফলে এখনও তিনি ওই চোখে স্বাভাবিকভাবে দেখতে পারেন না। আয়নায় বাম চোখে নজর পড়তেই সেই দুঃখস্মৃতি জীবন্ত হয়ে ওঠে তাঁর।
কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনটিতে?
“১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। রাতেই বড় ট্রুপস নিয়ে আমরা নবাবগঞ্জ শহর অভিমুখে রওনা দিই। সামনে এফএফ। পেছনে আর্টিলারি সর্পোট দেয় ভারতীয় সেনারা। অ্যাডভান্স করছি। খুব ভোরে আড়গাড়া নামক জায়গায় পাকিস্তানি সেনারা আমাদের ঠেকায়। ওখানে ছিল আম বাগান। ওরা টঙের উপর থেকে গুলি দিতেছে। আমরা আম গাছের আড়ালে পজিশনে। তুমুল গোলাগুলি চলছে। আমগো গুলিতে ওরাও মারা পরে। হঠাৎ পশ্চিমে একটা বাড়ি থেকে গুলি আসতে থাকে। আমি তখন দৌড় দিয়া সামনে যাই। গুলির শব্দে লাইন পজিশনে থেকে গুলি করছি। হঠাৎ ধুম ধুম করে কয়েকটা সেল এসে পড়ে। চোখের সামনে কুণ্ডুলি পাকানো ধোঁয়া। ‘চু’ করে স্প্লিন্টারগুলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
“সহযোদ্ধাদের দিকে তাকাতেই দেখি ফয়েজ আর বাদশা মাটিতে পড়ে গোঙাচ্ছে। তাদের পাশে আরও ছয়-সাতজন স্প্লিনটারে বিদ্ধ। আমি চারপাশ দেখছি। তখনও বুঝিনি আহত হয়েছি। হঠাৎ মনে হল বাম চোখ ভেজা ভেজা লাগে। হাত দিতেই দেখি পিনপিন করে রক্ত পড়ছে। সেলের স্প্লিনটার বাম চোখের নিচ দিয়ে বিদ্ধ হয়ে ভেতরে আটকে যায়। সহযোদ্ধারা আমায় পেছনে সরিয়ে নেয়।
“প্রাথমিক চিকিৎসা চলে প্রথমে পিয়াজবাড়ি ক্যাম্পে এবং পরে রাজশাহী সদর হাসপাতালে। স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সরকারিভাবে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় বুলগেরিয়ায়। সেখানেই অপারেশন করে চোখের ভেতর থেকে স্প্লিন্টার বের করে আনা হয়। এখনও বাম চোখ স্বাভাবিকভাবে কাজ করে না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে পারি না ভাই। বঙ্গবন্ধু দেশের বাইরে না পাঠালে হয়তো অন্ধ হয়েই জীবন কাটত।”
যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?
“সে দেশ পাইনি। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু সোনার বাংলার জন্য তো সোনার মানুষ দরকার। সে মানুষ তো তৈরি হয়নি। যারা মুক্তিযুদ্ধ করল, স্বাধীনের পর তাদের বলা হল যার যার পেশায় ফিরে যেতে। এটা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। যোগ্যতা মাফিক মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের কাজে যুক্ত করতে পারলে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অনেক আগেই সোনার দেশ হত।’
স্বাধীনতা লাভের পরের দেশ নিয়ে এ যোদ্ধা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত:
“একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ টেনে তোলার দায়িত্ব এসে পরে বঙ্গবন্ধুর ওপর। মানুষ যেন না খেয়ে না মরে– এটার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার পাশে থাকেনি অনেক মুক্তিযোদ্ধাও। জাসদ তৈরি হল। তারা তার বিরুদ্ধাচারণ করতে থাকল। সিরাজ সিকদারের কার্যকলাপও বঙ্গবন্ধুকে বিপাকে ফেলেছিল। এসবের সুযোগ নেয় স্বাধীনতাবিরোধীরা। বঙ্গবন্ধু যাদের বিশ্বাস করেছিলেন তারাই তার খুনিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে এরাই ইতিহাসের কালো অধ্যায় তৈরি করেছে। ফলে দেশ তখন চলতে থাকে উল্টো পথে।”
জিয়াউর রহমানের শাসনামল মূল্যায়ন করেন তিনি এভাবে:
“আমাদের জন্য ওটা ছিল কষ্টের সময়। জিয়া স্বাধীন দেশের পতাকা তুলে দিয়েছিলেন রাজাকারদের গাড়িতে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন! কিন্তু স্বার্থের জন্য, অর্থের জন্য আর ক্ষমতার জন্য ইতিহাসকে তিনি কলঙ্কিত করেছিলেন। সত্যিই কি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি? বিশ্বাস করি, একজন মুক্তিযোদ্ধা কখনও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির কাছে মাথা নত করবে না। রাজাকার কখনও মুক্তিযোদ্ধার বন্ধু হতে পারে না। তাহলে জিয়ার মন্ত্রিসভায় কেন রাজাকাররা স্থান পেল? তার দলের সঙ্গে এখনও কেন রাজাকারদের দলের বন্ধুতা?”
স্বাধীনতা লাভের পরপরই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার উপযুক্ত সময়। তখন ইন্ডিয়ান ট্রেনিং প্রাপ্তদের তালিকা ছিল। বেঁচে ছিলেন সব সেক্টর কমান্ডারও। অস্ত্র জমাদানের সময়ও মুক্তিযোদ্ধাদের একটা তালিকা তৈরি করা হয়। এগুলো সমন্বয় করলেই একটা নির্ভুল তালিকা তৈরি করা যেত– এমনটাই মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল। তালিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি:
“৪৬ বছর পরে সরকার কেন নতুন করে মুক্তিযোদ্ধার আবেদন নিচ্ছে? এতে তো ভুয়া বাড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখন তো মনে হয় অমুক্তিযোদ্ধারাই পুনর্বাসিত হবে। আমার এলাকায় ৯৬ জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা ছিল। এখন সেটা বেড়ে তিনশর উপরে। দুঃখজনক ইতিহাস এটা। নানা অজুহাতে অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার ভাতাও এখন বন্ধ করা হচ্ছে। তাদের মানসিক অবস্থাটা একবার ভাবুন। মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম– এটা আর কতবার প্রমাণ করতে হবে। সময়ের প্রয়োজনে যুদ্ধ করেছি। ভাতা খাওয়ার জন্য তো নয়।”
জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গে এই সূর্যসন্তান বলেন:
“জঙ্গিবাদের শেকড়ে যেতে হবে। একটা ভুল মন্ত্র দিয়ে এদের কেউ গাইড করছে। মানবতার ধর্ম ইসলাম আসলে ওরা মানে না। ওদের ধর্ম তো ইসলাম হতে পারে না। ওরা কী চায় এটাই তো পরিষ্কার না। তাই তৃণমূল পর্যায়ে মানুষকে বোঝাতে হবে। সরকারের ভেতরে ওদের লোক কারা, সেটাও বের করতে হবে।’
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা।
উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল বলেন:
“দেশের সফলতা আর তরুণ প্রজন্মের দেশপ্রেম দেখলে ভালো লাগে, আমার দেশের সোনার সন্তানেরা সারা বিশ্বে যখন বাংলাদেশের পতাকাকে তুলে ধরে তখন আনন্দে বুক ভরে যায়।”
খারাপ লাগে কখন?
“বঙ্গবন্ধুর কন্যার সঙ্গে যখন হেফাজতের সফি সাহেবের ছবি দেখি, তখন সত্যি খারাপ লাগে। এমন দৃশ্য কিন্তু আমরা আশা করিনি। এত তাড়াতাড়ি আমরা মতিঝিলের হেফাজতের তাণ্ডবের কথা ভুলে গেলাম! এটা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। দেশ ভুল পথে এগোবে। এতে লাভবান হবে স্বাধীনতা বিরোধীরাই।”
ভোটের কৌশলও হতে পারে এটা?
মুচকি হেসে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন:
“ধরুন আপনি সাংবাদিকতা করছেন। কিন্তু আপনি ইয়াবার মতো মাদক ব্যবসা করলে রাতারাতি ধনী লোক হয়ে যেতে পারেন। আপনি কিন্তু তা করছেন না। কেন? আদর্শগত বা নীতিগত একটা বিষয় হয়তো আপনার মধ্যে আছে। তাই সততার সঙ্গে কাজ করে উন্নতি করতে চাইছেন। আওয়ামী লীগও যদি হেফাজতের সঙ্গে ভোটের জন্য বন্ধুত্ব গড়ে তাহলে কিন্তু আদর্শগত বা নীতিগত বিষয়টি আর থাকে না। জামায়াতে ইসলাম বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী বলেন আর হেফাজতে ইসলাম– এদের উদ্দেশ্য কিন্তু একই। ভোটের হিসাব কষে আপনি মৌলবাদ ও উগ্রবাদ প্রশ্রয় দিচ্ছেন কি না সেটাও তো দেখতে হবে।”
পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরেই এদেশ একদিন সত্যিকারের সোনার বাংলা হবে– এমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. মোস্তফা কামালের। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন:
“এই যে আমায় খুঁজে বের করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে এসেছেন। আপনিও তো এ প্রজন্মেরই। তাহলে কেন আমরা প্রজন্মের ওপর বিশ্বাস হারাব?”
পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন:
“এদেশ ও মাতৃকার জন্য যারা আত্মত্যাগ করেছেন তাদের কথা তোমরা মনে রেখ। দেশের ইতিহাসটাও জেনে নিও। নিজের ইতিহাস না জানলে তোমরা তো নতুন ইতিহাস গড়তে পারবে না।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল : ১৪ মে ২০১৭
© 2017 – 2018, https:.