স্বাধীন দেশে নিজের মাটিই বেদখলে
শীতের কেবল শুরু। হালকা কুয়াশা জাল বুনেছে মাত্র। শিশির ভেজা ঘাস আর কুয়াশার জাল ভেঙে চলছে গ্রামের মানুষ। এমনই এক সকালে আমরা পা রাখি দিনাজপুরের বিরল উপজেলার সাকইরডাঙ্গা গ্রামে। এই গ্রামেই বসবাস করেন খ্রীস্টফার মুর্মূ। তিনি শুধু একজন আদিবাসীই নন, বরং একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও। স্মৃতির পাখায় ভর করে তিনি জানালেন শৈশব, কৈশোর ও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নানা ঘটনাপ্রবাহের কথা।
জোয়াকিম মুর্মূ ও মারিয়া মার্ডির পঞ্চম সন্তান খ্রীস্টফার। সাঁওতাল রীতিতে বাবার টাইটেল লাভ করায় পুরোনাম হয় খ্রীস্টফার মুর্মূ। বাবার ছিল ১২-১৩ বিঘা জমির গৃহস্ত। গ্রামে তখন ৫০ ভাগই সাঁওতাল। সনাতন-রীতির বাহাপরব আর সোহরাই উৎসব চলত ধুমধামের সঙ্গে। আমোদ-প্রমোদ আর ঢোল-খোলের বাদ্যিতে বাড়ি বাড়ি আসর জমত আদিবাসী নৃত্যের।
মা-বাবার আদরের সন্তান ছিলেন খ্রীস্টফার। অন্য ভাইবোনরা গৃহস্তর কাজ দেখাশোনা করত। কিন্তু পরিবারের ইচ্ছায় তিনি সুযোগ পান লেখাপড়ার। সেটিও খুব সহজ ছিল না। ১০ মাইল দূরে দিনাজপুর শহর। হেঁটে ও নদী পার হয়ে প্রতিদিন খ্রীস্টফার যেতেন ওখানকার সেন্ট ফিলিপ স্কুলে। অবসর কাটত পাড়ার বন্ধু হাকিম, জব্বার, মণ্ডল, রমজানের সঙ্গে। জাতিভেদ শব্দটি তখনো জন্ম হয়নি। আদিবাসী-বাঙালিতেও ছিল না কোনো সংঘাত। তাই বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে বারণ ছিল না। ফুটবল খেলা আর দলভেদে পুনর্ভবা নদীতে মাছ ধরার আনন্দের মাঝেই কেটে যায় খ্রীস্টফারের শৈশব ও কৈশোর।
কথার সঙ্গে কথা এগোয়। খ্রীস্টফার মুর্মূ বলেন স্কুলজীবনের নানা কথা। তাঁর ভাষায়, ‘সাঁওতালদের মধ্যে শিক্ষার হার ছিল কম। তাই তারা জমিজমা সুরক্ষা করতে পারত না। মুখের কথাই ছিল সব। মানুষের মাঝে ছিল সততা আর বিশ্বাস। সাঁওতালদের মধ্যে সে সময় একমাত্র আমিই স্কুলে যাই। সঙ্গে যেত একই গ্রামের পশর উদ্দিনের ছেলেমেয়েরা। ১৯৭১ সালে আমি ছিলাম দিনাজপুর সেন্ট ফিলিপ স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র।’
স্কুল থেকে মাঝেমধ্যেই মিছিলে যেতেন খ্রীস্টফার। দিনাজপুরের ইউসুফ প্রফেসরসহ নেতাদের মুখে শুনে আসতেন নানা বৈষম্যের কথা। তিনি বলেন, ‘কাগজ পূর্ব পাকিস্তানে তৈরি হলেও আমাদেরই বেশি দামে কিনতে হতো। পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল কম দাম। একই অবস্থা ছিল চিনিতে। দিনাজপুরে ছিল বিহারিদের আধিপত্য। তারা ছিল পাকিস্তানপন্থী। একবার বিহারিদের ইকবাল স্কুলের সঙ্গে আমাদের সেন্ট ফিলিপ স্কুলের মারামারি হয়। চলার পথে ওরা নানাভাবে আমাদের কটূক্তি করত।’
ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের দিনাজপুর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকণ্ঠ কুঠিবাড়ীতে। ২৮ মার্চ, ১৯৭১। বাঙালি অফিসার ও জওয়ানদের বিরুদ্ধে ওখানে অস্ত্র ধরে পাঠান-পাঞ্জাবিরা। শুরু হয় গোলাগুলি। সেখান থেকে বাঙালি ইপিআর জওয়ান হাতিয়ারসহ বেরিয়ে আসে ব্যারাক থেকে। নিজের বাড়ি ফেলে খ্রীস্টফাররা পরিবারসহ তখনই আশ্রয় নেন বর্ডারের কাছাকাছি, ধর্মজায়েন গ্রামে। অতঃপর মে মাসের প্রথম দিকে চলে যান ভারতে।
ট্রেনিংয়ে যাওয়ার কথা শুনি মুক্তিযোদ্ধা খ্রীস্টফার মুর্মূর জবানিতে। তাঁর ভাষায়, “ভারতে বেকার সময় কাটাচ্ছি। হঠাৎ দেখা জর্জদার (জর্জ আর এন দাশ) সঙ্গে। তিনি ছিলেন ইপিআরে। বললেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প করতে চাই। তোমরাও আসো।’ ফুফাতো ভাই পিউস হেমব্রম ও জন মার্ডিসহ পরদিনই চলে গেলাম শিববাড়ীতে। তখনো ক্যাম্প হয়নি। কয়েকটি অস্ত্র সংগ্রহ করে জর্জদা ট্রেনিং শুরু করেন। ১৫-২০ দিন শিখলাম শুধু লোড, আনলোড আর পজিশন। ধীরে ধীরে লোক বাড়তে থাকল। খাবারের কষ্ট ছিল বেশি। শিববাড়ী মিশন থেকে পাওয়া রিলিফের চালই তখন ভরসা। পরে আমাকে হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয় ভারতের পতিরাম ক্যাম্পে। সেখানে ট্রেনিং নিই এক মাস। রাইফেল, এলএমজি, এসএলআর, স্টেনগান চালোনো শিখি। থ্রিনটথ্রি ভালো চালাতাম। ওই ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন ক্যাপ্টেন শ্রী হরি। আর ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন এক বাঙালি সেনা। দুষ্টুমি করে আমরা তাকে ‘পাংগাস’ বলে ডাকতাম। ট্রেনিং শেষে আমাদের পাঠানো হয় হামজাপুর ক্যাম্পে। ৭ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর ছিল সেটি। সেখান থেকেই পাই অস্ত্র।”
মুক্তিযোদ্ধা খ্রীস্টফার মুর্মূদের ১২ জনের দলের কমান্ড করতেন ইয়াকুব ও আনোয়ার। তাঁরা অপারেশন করেন ৭ নম্বর সেক্টরের হিলি, স্কুলপাড়া, বিরলসহ দিনাজপুর এলাকায়।
একবার তাঁদের দলটি অল্পের জন্য রক্ষা পায় পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে।
পলাশবাড়ীর পূর্বপাশে ছিল সালাম পুকুর। পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্প ছিল সেখানে। সেই ক্যাম্প দখলে নিতে হবে। তাই গেরিলা সেজে খ্রীস্টফাররা গ্রামের এক পরিচিত লোকের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ওই লোকটির নাম ছিল কফিল হাজি। তিনি যে পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে কাজ করেন, এটা তাঁদের জানা ছিল না। তিনি একটি ঘরের ভেতর মুড়ি-গুড় খেতে দেন। ক্ষুধার মধ্যে খ্রীস্টফাররা মুড়ি খাওয়ায় ব্যস্ত। সে সুযোগে কফিল হাজি বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে দেন। অতঃপর খবর দিতে চলে যান পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে। খানিক পরেই তার পরিকল্পনা বুঝে যান খ্রীস্টফাররা। বহু কষ্টে জানালা ভেঙে তাঁরা আশ্রয় নেন নদীর ধারে। পাকিস্তানি সেনারা ঘরে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে কফিল হাজির ওপরই চড়াও হয়। পরে খ্রীস্টফাররা ওই পাকিস্তানি দালাল কফিল হাজিকে তুলে নিয়ে যান কালিয়াগঞ্জ শালবনে।
দিনাজপুর মুক্ত হওয়ার বর্ণনা দেন এই বীর সূর্যসন্তান। তিনি বলেন, ‘হামজাপুর ক্যাম্প থেকে সুন্দরায় বর্ডার হয়ে আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করি। উদ্দেশ্য, দিনাজপুর শহর দখলে নেওয়া। বিভিন্ন দলে আমরা ৬০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা। পেছনে ভারতীয় সেনাবাহিনী। রাতে এসেই পজিশন নিই সদরের স্কুলপাড়ায় খালের পাড়ে। খালের এক পাশে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি। দুপাশে চলে সম্মুখ যুদ্ধের তুমুল প্রস্তুতি। ভোর হতেই শুরু হয় গোলাগুলি। তা চলে বিকেল পর্যন্ত । বড় যুদ্ধ ছিল ওইটা। মাথার ওপর দিয়ে শোঁ শোঁ করে গুলি চলে। একটু উনিশ-বিশ হলেই মারা পড়তে হতো। সন্ধ্যার আগেই আমরা দখলে নিই ঘুঘুডাঙ্গা পর্যন্ত। সেখান থেকে আমাদের দলটি নদীর পশ্চিম অংশ দিয়ে শহরের দিকে আসতে শুরু করে। বিরল থেকে আরেকটি দলও এগিয়ে আসে। ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। ভোরবেলা। কুঠিবাড়ী দিয়ে ষষ্ঠীতলা হয়ে আমরা শহরের মডার্ন মোড়ে এসে পজিশন নিই। বিরল মুক্ত হয় তারও এক-দুদিন আগে।’
মৃত্যুকে তুচ্ছ করে দেশকে শক্রমুক্ত করেছেন এই আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু স্বাধীন দেশে নিজের দুই একর ২৬ শতক জমিই আজ স্থানীয় বাঙালিদের দখলে। আদালতের রায় পেয়েও দখল নিতে পারছেন নানা হুমকির মুখে। তবুও এই দেশকে স্বাধীন করে তৃপ্ত খ্রীস্টফার মুর্মূ। শুধু বললেন, ‘আমার দেশের মাটি আমাকেই রক্ষা করতে হবে। তাই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছি। দেশ পেলাম। কিন্তু স্বাধীন দেশে নিজের মাটিই আজ বেদখলে। এই দুঃখ কাকে বলব, দাদা। ভেবেছি, দেশ স্বাধীন হবে। শক্রমুক্ত থাকবে। সমঅধিকার থাকবে। দলাদলি বা বিভেদ থাকবে না। এখন তো তার বিপরীতে। ছোট্ট একটা দেশ অথচ কত দল। তাদের হানাহানিতে মরছে সাধারণ মানুষ। এটা তো আশা করিনি।’
আট হাজার টাকা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা আর গ্রিলের ব্যবসা করে যা আয় করেন, তাই দিয়েই চলছে এ মুক্তিযোদ্ধার পাঁচ সদস্যের পরিবার। ভাতা বৃদ্ধির জন্য তিনি কৃতজ্ঞ বর্তমান সরকারের প্রতি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি মনে করেন, রাজনীতিবিদদের মধ্যে সত্যিকারের দেশপ্রেম থাকলে, স্বার্থপরতা আর দুর্নীতি বন্ধ করা গেলে এবং দল থেকে আগাছা দূর করতে পারলে দেশ আরো এগিয়ে যাবে। পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি পাহাড়সম আশা আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা খ্রীস্টফার মুর্মূর। মনেপ্রাণে তিনি বিশ্বাস করেন, প্রজন্মরাই সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়বে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি.কমে, প্রকাশকাল: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬
© 2016 – 2018, https:.