শিশু ধর্ষণরোধের চাবিকাঠি
এইসব গুপ্ত ও বিকৃত মানসিকতার মানুষের থাবা থেকে শিশুকে রক্ষা করতে পরিবারের ভেতর থেকেই শুরু করতে হবে সচেতনতা। আপনার শিশুটিকে বিশ্বাস করুন, তার কথাকে গুরুত্ব দিন, তার আত্মরক্ষার কৌশলটি তাকে শেখান। সর্বোপরি শিশুটির পরিবার যেন হয় তার সবচেয়ে বড় আস্থার জায়গা। এই বোধটি শিশুর মনে গেঁথে দিতে হবে। এ দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের সবাইকেই।
বছর খানেক আগের ঘটনা। ঢাকা মহানগরেই বাস করে আমার এক বাল্যবন্ধু। সফল ব্যবসায়ী সে। সারাদিন কাটে ব্যস্ততায়। তাই একমাত্র ছেলেটিকে তেমন সময় দিতে পারে না। কিন্তু ছেলের লেখাপড়ার বিষয়ে এতটুকু ঘাটতি রাখতে রাজি নয় সে।
ছেলে পাঁচ পেরোতোই ব্যবস্থা হয় আরবী শিক্ষার। স্থানীয় স্কুলের এক আরবী শিক্ষককে রাখা হয় এ কাজের জন্য। প্রতিদিন দুপুরে দুঘন্টার জন্য পড়াতে আসেন তিনি। নিরিবিলি একটি কক্ষে পড়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। মাস খানেক পরেই বেঁকে বসেন বন্ধুর ছেলে শিশুটি। বাবা-মাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে সে। এ হুজুর ভাল নয়, আমি উনার কাছে পড়ব না। এমন অভিব্যক্তি ছিল ছেলে শিশুটির।
শিশু বলে বাবা-মা তার কথায় গুরুত্ব দেয় না। বরং শিশুটির ওপরই রাগ করে তারা। আরবী না পড়ার অজুহাতেই হুজুর সম্পর্কে খারাপ ধারণা দিচ্ছে সে। এমনটা ভাবে তার বাব-মা।
এভাবে ওই শিশুটিকে অবিশ্বাস করে তারা। শুধু তাই নয়, আরবী পড়াকে গুরুত্ব দিয়ে পাড়ানোর সময়টাতে তারা কক্ষের দরজাটিও বন্ধ করে রাখার ব্যবস্থা করে। এভাবেই বন্ধুর ছেলে শিশুটির আরবী পড়া চলতে থাকে বছর খানিক।
এদিকে ওই শিশুটি ক্রমেই শারীরিকভাবে রোগাপাতলা হতে থাকে। খাওয়া-দাওয়াও কমে যেতে থাকে তার। ডাক্তার দেখিয়েও কোনো ফল হয় না। শিশুটিও তার মনের কথা খুলে বলে না তার বাবা-মায়ের কাছে। শারীরিক অবস্থা দেখে ক্রমেই চিন্তিত হয়ে পড়ে বন্ধুটি। কিন্তু এক দুপুরে উন্মোচিত হয় সবকিছু। সবাই জেনে যায় প্রকৃত ঘটনা।
বন্ধুর ছেলে শিশুটিকে শারীরিকভাবে পাশবিক নির্যাতন করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে ওই আরবী শিক্ষক। খানিক উত্তম-মধ্যমের পরেই তিনি স্বীকার করেন যে, শিশুটির ওপর তার এই পাশবিকতা চলেছে গত এক বছর। নিরবে মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করেছে শিশুটি। কারও কাছে মুখ না খুলতে নানাভাবে শিশুটিকে ভয় দেখাতো ওই শিক্ষক।এভাবে এক একটি দুপুর তার কাছে হয়ে ওঠে একএকটি অভিশাপ। ফলে শারীরিকভাবে সে অসুস্থ হতে থাকে।
পরে বিষয়টি গণমাধ্যমেও উঠে আসে। তবে সামাজিকতার ভয়ে আমার ওই বন্ধুটি যদিও ওই শিক্ষককে পুলিশে ধরিয়ে দিতে বা মামলা করতে এতোটুকু পিছ পা হয়নি। কিন্তু তার চোখ দুটো বারবার ভিজে যাচ্ছিল তারেই শিশুটিকে অবিশ্বাস বা তার কথাকে গুরুত্ব না দেওয়ার অপরাধের জন্য। বন্ধুটির মুখে সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল- ‘অভিভাবক হিসেবে নিজের শিশু সন্তানের অস্বস্তিকে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণেই আমার শিশুটি এই পাশবিক নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। তাই এই দায় আমাদেরও।’বন্ধুর এই আত্মোপলব্ধি আজও আমাকে নাড়া দেয়।
উপরের ঘটনাটিতে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে শুধু মেয়ে শিশুরাই ধর্ষণের স্বীকার হয় না বরং ছেলে শিশুরাও এর দ্বারা আক্রান্ত।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর বলছে চারদিকে আজ ধর্ষণের মহোৎসব চলছে। গত চারবছরে ১৩০১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৬৯ জন শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৯৩ জনকে এবং ৩২ জন শিশু আত্মহত্যা করেছে। বাস্তবে এ সংখ্যা হয়তো আরও অনেক বেশি। কেননা লোকলজ্জা আর সামজিক দৃষ্টিভঙ্গির ভয়ে অনেক শিশু ও তার পরিবারের কষ্টের চাপা কান্নার খবরগুলো উঠে আসেনি পত্রিকার পাতায়। আবার এ পরিসংখ্যান শুধুমাত্র মেয়ে শিশু নির্ভর। কিন্তু এ পর্যন্ত কতজন ছেলে শিশু এর দ্বারা আক্রান্ত সেই পরিসংখ্যান কিন্তু আমাদের জানা নেই।
২০৪১ সালে হবে উন্নত বাংলাদেশ। সেই স্বপ্নময় পথে এগোচ্ছে সরকার। কিন্তু উন্নত বাংলাদেশ মানে আসলে কী? খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে শুধু উন্নয়ন করা! নাকি ন্যায় বিচার, মানুষের অধিকার ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা?
সারা পৃথিবীতে শিশু অধিকারের বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে অনুসরণ করা হয়। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের কর্ণধর। তাই শিশু নির্যাতনের বিষয়গুলোকে উন্নত দেশে স্পর্শকাতর বিবেচনা করে জিরো টলারেন্স হিসেবে মানা হয়। কিন্তু আমরা কি এগোচ্ছি সেই পথে?
শিশু ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা অতি দ্রুত নিশ্চিত করে তা কার্যকরের কোনো দৃষ্টান্ত এদেশে আজও আমরা দেখি নি। বরং বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও আইনের নানা ফাঁকফোঁকর দিয়ে নিশ্চিত জীবনে ফিরে এসেছে অনেক ধর্ষক।
ফলে বিচারহীনতার এই সংস্কৃতির কারণে সমাজে ক্রমাগত বাড়ছে ধর্ষণেজনিত অপরাধ। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের ফলে মেয়ে শিশুটিও তার পরিবার নিদারুণ কষ্ট আর অপমানের মধ্য দিয়ে দিন কাটায় এদেশে। এমনটা তো আমরা প্রত্যাশা করি না। আমরা চাই রাষ্ট্র শিশু ধর্ষণের বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখাক। শিশু ধর্ষণের কঠিন শাস্তি দ্রুত নিশ্চিত হোক।
শিশু ধর্ষণের বিরুদ্ধে অনেকেই নানা কর্মসূচি নিয়ে পথে নেমেছেন। কেউ কেউ দাবী তুলেছেন অতি দ্রুত এই অপরাধের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করার। যাতে ভয়ে সহজে কেউ এই অপরাধের কথা চিন্তাও করতে না পারে। এটা যেমন প্রয়োজন তারচেয়ে অনেক বেশি দরকার পারিবারিক, সামজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতনতার। কেননা শুধু আইন দিয়েই এই অপরাধীদের থেকে আমরা আমাদের শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারব না।
শিশু ধর্ষক আসলে কারা? আপনার আমার সম্পর্কের মুখোশ পরা কোনো পুরুষ বা পরিচিতজন। কখনও সে ভাই, কখনও কাকা, কখনও নানা-দাদা-চাচা কিংবা ওঁত পেতে থাকা কোনো হায়নারূপি মানুষ। যার কাছে আমাদের শিশুটি খুব সহজভাবেই যেতে আগ্রহি। আপনার ও আমার সম্পর্কের মাঝেই ঘাপটি মেরে বসে আছে কোনো ধর্ষক। ঘটনা ঘটার আগে যাদের আমরা সহজে চিহ্নিত করতে পারি না। যখন তার পশুরূপটি উন্মোচিত হয় তার আগেই আমাদের শিশুটি ক্ষতবিক্ষত হয় শারীরিক ও মানসিকভাবে।
শিশুধর্ষণরোধের চাবিকাঠি হলো, এইসব গুপ্ত ও বিকৃত মানসিকতার মানুষের থাবা থেকে শিশুকে রক্ষা করতে পরিবারের ভেতর থেকেই শুরু করতে হবে সচেতনতা। আপনার শিশুটিকে বিশ্বাস করুন, তার কথাকে গুরুত্ব দিন, তার আত্মরক্ষার কৌশলটি তাকে শেখান। সর্বোপরি শিশুটির পরিবার যেন হয় তার সবচেয়ে বড় আস্থার জায়গা। এই বোধটি শিশুর মনে গেঁথে দিতে হবে। এ দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের সবাইকেই।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে পরিবর্তন. কমে, প্রকাশকাল: নভেম্বর ১৬, ২০১৬
© 2016 – 2018, https:.