সত্যিকারের ঘটনাগুলো বাঁচিয়ে রাখতে হবে
চারটা গুলি লেগে আমার ডান হাতের মেইন রগডা ছিড়ে যায়। হাতটা অকেজো হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তাররা হাতটা কেটে ফেলতে চেয়েছিল। স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সরকারিভাবে আমাকে পাঠানো হয় জার্মানিতে। সেখান থেকে লাগানো কৃত্রিম রগ দিয়েই চলছে ডান হাতটি। কিন্তু কষ্টতো কমেনি। মুক্তিযুদ্ধ শেষ। কিন্তু কই আমিতো এহনও ঘুমাতে পারি না। চোখ বুজলেই সহযোদ্ধা শফিক আর মাহবুবের রক্তাক্ত লাশ দেখি। রাতে এহনও জাইগা উঠি শহীদদের গোঙগানি আর কান্নার শব্দে। আর্টিলারি বিস্ফোরণের বিকট শব্দে প্রায় রাতেই লাফিয়ে উঠি। ঘুম ভেঙে যায়। শরীরটাও ঘামতে থাকে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মুখগুলো মধ্যরাতে জীবন্ত হয়ে ওঠে। একাত্তরের শহীদ যোদ্ধারা আমায় ঘুমাতে দেয় না ভাই।
“আমগো গ্রামডা ছিল তিতাসের পারে। বইস্সা মাসে টেডা আর পলো নিয়া বের হইতাম। ধরা পড়ত বড় বড় সইল, গজার, কাতল আর রুই। কাগজ-কলম তহন ছিল না। ছিল কম দামি নিউজ পেপার। বাঁশের কঞ্চি কাইট্টা শুকাইয়া আমরা কলম বানাইতাম। ওইডারে কয় ‘কাট কলম’। কিন্তু কালি পাই কই? রান্না করার মাটির পাতিলের নিচের কালা অংশ তুইলা কালি বানাইতাম। আর ছিল ছিটকি গাছের রঙ। ওই কালি দিয়া মোডা মোডা অক্ষরে লেহা হইত। এহন তো লেহাপড়ায় কষ্ট কম। আগে বাল্যশিক্ষা বইডা পড়লেই চলত। ‘সদা সত্য কথা বলিব’, ‘গুরুজনকে মান্য করিব’, ‘বাবা-মার কথা মানিয়া চলিব’– এইসব শিখছি বাল্যশিক্ষা থাইকাই। এহন বাল্যশিক্ষা লাগে না। বাচ্চারা তোতাপাখির মতন ইংলিশ কইলেই সবাই খুশি।
“বাবা ছিল মাস্টার। তাই সবাই আমার লগে মিশত। বাড়তি আদরযত্নও ছিল। কিন্তু তাই বইলা দুরন্ত কম ছিলাম না। আনন্দফূর্তিও করছি অনেক। মাহফিল, যাত্রাগান, পালাগান, বাউলগান কোনোটাই বাদ যাইত না। দূর গ্রামে গিয়া ননি ঠাকুর, বুড়ি সরকার, বারেক সরকার, মাতাল রাজ্জাক, মান্নান আর আনোয়ার বয়াতির গানের পালা দেখছি রাত যাইগা। রূপবান, আলোমতি, গুনাইবিবির যাত্রাপালার কথা এহনও মনে হয়।
“বাবার জমি ছিল ১২ একরের মতো। ফসল হইত একটা। পরিবার বড়। তাই কষ্ট ছিল বেশি। অভাবের কারণে বাবায় জমি বেচছে। স্কুল থাইকা আইসা খাওন পাই নাই তহন। কন, কী লেহাপড়া করমু? তাই ছয় ক্লাসেই লেহাপড়া শেষ। তিনবেলা খাইতে পারছি খুব কম। একটা পাঞ্জাবি দিয়া গোটা গুষ্টি তহন বিয়া করত। এক জোড়া জুতা পাল্টায়া পাল্টায়া গোটা পাড়ার লোক পড়ত।
“এহন তো সেই যুগ নাই। কৃষির উন্নতি হইছে চিন্তার বাইরে। বাবার ওই জমি এহন হইলে কোটিপতি থাকতাম। কোট-প্যান্ট পইরা গ্রামের লোকও এহন সাহেব হইছে। যারা বলে দেশ স্বাধীন হইয়া কিছুই হয় নাই। আমি কই, ‘তারা হয় অন্ধ, না হয় পাগল’।
পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহন মিয়া। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ৩ নং সেক্টরের আলফা কোম্পানির কলাগাইছা ক্যাম্পের ওয়ান প্লাটুনের কমান্ডার। যুদ্ধদিনের নানা ঘটনা শুনতে এক সকালে আমরা তাঁর মুখোমুখি হই। কথা এগিয়ে চলে নানা ঘটনাপ্রবাহে।
লাল বক্স মাস্টার ও মরিয়ম বেগমের নয় সন্তানের মধ্যে মোহন মিয়া দ্বিতীয়। গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার চিনাইর গ্রামে। তাঁর বাবা ছিলেন চিনাইর ও চাপুর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি চাপুর প্রাইমারি স্কুলে। পরে তিনি ভর্তি হন চিনাইর আঞ্জুমানারা হাই স্কুলে।
লেখাপড়া ছাড়ার পর মোহন এক মাসের মোজাহিদ ট্রেনিং নেন মেরাশানিতে। এর কিছুদিন পরেই যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। সে ইতিহাস শুনি তাঁর জবানিতে–
“১৯৬৪ সালের প্রথম দিকের কথা। তহন রেডিওতে ফৌজি অনুষ্ঠান হইত। একদিন শুনলাম আর্মিতে লোক নিব। ৫ম শ্রেণি পাস হলেই চলে। আমি কুমিল্লা রেস্ট হাউজে গিয়া দাঁড়াইলাম। মোজাহিদ ট্রেনিংয়ের সর্টিফিকেট দেইখাই সিপাহি হিসেবে ওরা নিয়া নিল। আর্মি নাম্বার পড়ল ৩৯৪০৫০১। প্রথম ট্রেনিং চলে চট্টগ্রাম ইবিআরসিতে। পরে পোস্টিং হয় সেকেন্ড বেঙ্গল, ষোল ইস্ট বেঙ্গল, পঁয়ত্রিশ বেঙ্গল ও বাইশ বেঙ্গলে। ১৯৭১ সালে আমি ছিলাম সেকেন্ড বেঙ্গলে।”
পাকিস্তানি আর্মির ব্যারাকে বৈষম্যের প্রসঙ্গ উঠতেই মোহন মিয়া বলেন–
“বেঙ্গল রেজিমেন্টে বাঙালি ছিল বেশি। তবুও তিনবেলা রুটি দিত। সাপ্তাহে একদিন ভাত খাওয়াইত। তাও একবেলা। কিছু বললে পাঞ্জাবিরা বলত, ‘বাঙালকে বাচ্চা, ভাত কিছকো খাতায়ে.. ভাত নেহি হে.. চাল বাতাও।’ আমাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হলেই পাঞ্জাবি সুবেদররা রেগে গিয়ে বলত, ‘বাঙালকা বাচ্চা কোভি নেহি আচ্ছা, যো হোতা হে আচ্চা হারামিকা বাচ্চা।’ এই সব শুনেও মুখ বুঝে থাকতে হত।”
৭ মার্চ ১৯৭১। মনের ভেতর তখন বঙ্গবন্ধু আর স্বাধীনতার স্বপ্ন। তবু রেসকোর্সের আশপাশের এলাকায় টহলে পাঠনো হয় মোহন মিয়াদের। টহল টিমের কমান্ডার ছিলেন হাবিলদার মুজিবুল হক এবং এম এ মনসুর। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরই ডিফেন্সে ডিভাইডেশন শুরু হয়।
ভিডিও দেখতে :
https://www.youtube.com/watch?v=qoCGwNh2SQ0
মোহন মিয়ার ভাষায়–
“স্বাধীনতা যুদ্ধের সবরকম নির্দেশনা ছিল ভাষণটিতে। শেখ সাহেব বললেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমার এদেশের মানুষের অধিকার চাই। …আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল…।’ এরপর তো আর কিছুই বলার বাকি থাকে না।”
আপনারা তখন কী করলেন?
“২৫ মার্চের আগেই জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে সংঘর্ষ হয়। আমরা তখন জয়দেবপুর থেকে তেইল্লাপাড়া দিয়ে ৩ নং সেক্টরের হেজামারা হেডকোয়ার্টারে চলে যাই। ওই সেক্টরের আলফা কোম্পানির কলাগাইচ্ছা ক্যাম্পের ওয়ান প্লাটুনের কমান্ডার ছিলাম। আমার কমান্ডে ছিল ৪০ জন যোদ্ধা। প্রথম দিকে অপারেশন চালাই আখাউড়া ইপিআর হেড কোয়ার্টারে, আজমপুর রেল কলোনি, সিংগাইর বিল প্রভৃতি এলাকায়। গেরিলা অপারেশন করেছি। কাজ ছিল ভবন, ব্রিজ, পাওয়ার স্টেশনগুলো উড়িয়ে দেওয়া। রাতের দিকে অপারেশন করে আবার ফিরে আসতাম হেজামারায়।
“তখন কারো বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা পানি খেলে পরদিনই আর্মি আর রাজাকাররা তার বাড়ি পুড়িয়ে দিত। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে– এমন খবর পেলে ওই পরিবারের লোকদেরও মেরে ফেলা হত। এই ভয়ে অধিকাংশ মানুষই মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেনি। এটাই ছিল বাস্তব অবস্থা।”
মোহন মিয়ারা পানি চেয়েও অনেক বাড়ি থেকে পানি পাননি। তখন আওয়ামী লীগ করেন– এমন ব্যক্তিও ভয়ে সাহায্য করেননি মুক্তিযোদ্ধাদের। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আক্ষেপের সুরে বললেন মুক্তিযোদ্ধা মোহন।
৩ নং সেক্টর থেকে মোহন মিয়াকে একমাসের জন্য পাঠানো হয় ভারতের লোহারবন ট্রেনিং সেন্টারে। সেখানে তিনি ট্রেনিং ইন্সেট্রাক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জুলাইয়ের শেষের দিকে চলে আসেন ৪ নং সেক্টরে। যুদ্ধ করেন কানাইঘাট, জুরি, ভাঙ্গা, বড়লেখা, লাতু, জকিগঞ্জ, পেচিগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায়। মাস খানেক পরেই নির্দেশ আসে নিজ এলাকায় গিয়ে অপারেশন করার। মোহন মিয়া তখন ফিরে যান ৩ নং সেক্টরে।
অকুতোভয় এই বীর যোদ্ধা এক অপারেশনে মারাত্মকভাবে আহত হন। পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে বিদ্ধ হয় তাঁর বুক, ডান হাতের বাহু, পেটের ডানদিক, পা ও শরীরের বিভিন্ন স্থান। বর্তমানে তাঁর হাতের বাহুতে কৃত্রিম রগ লাগানো আছে। শারীরে ‘পয়জন’ এখনও রয়ে গেছে। তাই দিনে ২০ থেকে ২৫ বার বমি হয়। তা দমাতে এখন খানিক পর পরই তাঁকে সিগারেট খেতে হয়। ১৯৭১ সালেই শেষ নয়, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এভাবেই দেশের জন্য কষ্ট মেনে নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে এই মুক্তিযোদ্ধাকে।
কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনটিতে?
“আমরা ছিলাম ৩ নং সেক্টরের আজমপুর রণাঙ্গনে। ডিফেন্স নিয়ে মুভ করছি। উদ্দেশ্য ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়া। পেছনে ইন্ডিয়ার আর্মি। মুখোমুখি তুমুল যুদ্ধ চলছে। ওগো ডিফেন্স ছিল উজানিশা, কোড্ডায়, সুলতানপুর আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। আখাউড়া টু মোকন্দুপুর। ওরা একটা খাল কাইটা রাখে। যাতে আমরা ট্যাংকসহ ইন্ডিয়া থেকে আসতে না পারি। আজিমপুর গ্রামে ওই খালের পূর্বপাশে ছিলাম আমরা। পশ্চিমে পাঞ্জাবিরা। দুই পক্ষের গুলি আর আর্টিলারিতে আখাউড়া স্টেশনের প্লাটফর তখন পুকুর হয়ে গেছে।
“৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। সকালে পাকিস্তানি সেনারা চারটা বিমান নিয়ে আমাদের ওপর অ্যাটাক করে। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে তিনটি বিমানই ধ্বংস হয় কুমিল্লা ও নবীনগরে। পেয়ারা-কাঁঠাল বাগান এলাকায় ছিল আমাদের পজিশন। ওরা আর্টিলারি ছুড়ছে। গোলাগুলিও চলছে। আমরা বাংকারে। থেমে থেমে গুলি চালিয়ে জবাব দিচ্ছি। পাশের বাংকারে ছিল সহযোদ্ধা শফিক। ধুম কইরা একটা আর্টিলারি আইসা পড়ে ওর শরীরে। দেখলাম ওর ঠ্যাং দুইটা বাংকারের ভেতর আর শরীরটা ঝুইলা আছে গাছে। কয়েক মিনিট পরে একইভাবে মারা যায় সহযোদ্ধা মাহবুব। ওগো দিকে একটু আগাইতেও পারি নাই। কয়েক পলক শুধু তাকায়া ছিলাম। বিকাল তখন ৪টা কী ৫টা। সূর্যটা লাল হয়ে উঠছে। এলএমজিটা তুলে গুলি করছি। হঠাৎ মনে হল বডি ঠিক কাজ করছে না। তহনও বুঝি নাই পাকিস্তানিগো গুলি লাগছে আমার বুক, ডান হাতের বাহু, পেটের ডানদিক, পা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে। খানিক পরেই উল্টে পড়ে গেলাম মাটিতে। এরপর আর কিছুই মনে নাই।”
চিকিৎসা নিলেন কোথায়?
“প্রথমে আগড়তলায় এবং পরে চিকিৎসার জন্য আমাকে পাঠানো হয় গোহাটি হাসপাতলে। চারটা গুলি লেগে আমার ডান হাতের মেইন রগডা ছিড়ে যায়। হাতটা অকেজো হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তাররা হাতটা কেটে ফেলতে চেয়েছিল। স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সরকারিভাবে আমাকে পাঠানো হয় জার্মানিতে। সেখান থেকে লাগানো কৃত্রিম রগ দিয়েই চলছে ডান হাতটি। কিন্তু কষ্টতো কমেনি। মুক্তিযুদ্ধ শেষ। কিন্তু কই আমিতো এহনও ঘুমাতে পারি না। চোখ বুজলেই সহযোদ্ধা শফিক আর মাহবুবের রক্তাক্ত লাশ দেখি। রাতে এহনও জাইগা উঠি শহীদদের গোঙগানি আর কান্নার শব্দে। আর্টিলারি বিস্ফোরণের বিকট শব্দে প্রায় রাতেই লাফিয়ে উঠি। ঘুম ভেঙে যায়। শরীরটাও ঘামতে থাকে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মুখগুলো মধ্যরাতে জীবন্ত হয়ে ওঠে। একাত্তরের শহীদ যোদ্ধারা আমায় ঘুমাতে দেয় না ভাই।”
সহযোদ্ধাদের স্মৃতিতে চোখ ভেজান মুক্তিযোদ্ধা মোহন মিয়া। আমরা তখন নিশ্চুপ। সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা জানা নেই। শুধু ভাবি, অনেক রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের পূর্বসূরিরা ছিনিয়ে এনেছিলেন স্বাধীনতার লাল সূর্যটাকে। তাঁদের ঋণ কী দিয়ে শোধ করব আমরা!
স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তাঁর ভাষায়–
“স্কুলের হেড মাস্টারের নির্দেশে ঘণ্টা বাজাইছে দফতরি। তাই বইলা কি দফতরি নির্দেশের মালিক হইব? অনেকের মতো জিয়াও দফতরির কাজটাই করেছেন। আমি লেইখা দিছি। ঘোষণা দিছেন আপনি। তাই বলে তো ঘোষণার মালিক আপনি না। এইটা তো সহজেই বোঝা যায়। খালি কইলেই তো হইব না।”
স্বাধীনতার পরে দেশের অবস্থা নিয়ে তিনি বলেন–
“পাকিস্তানে আটকা পড়া বাঙালি সেনা ও অফিসারদের চাকুরিতে ফিরিয়ে আনা ছিল বড় ভুল। আবার যাঁরা যুদ্ধ করেছেন তাঁদের সিনিয়রিটি দেওয়াটাও ঠিক হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে জিয়া মুক্তিযোদ্ধা সেনা ও অফিসারদেরও ওপর চড়াও হন। তাঁর হাত ধরেই রাজাকার শাহ আজিজ প্রধানমন্ত্রী হন। রাজাকারদের তিনি জেল থেকে মুক্ত করে দেন। এ দেশে একমাত্র জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের হেয়, কলঙ্কিত ও হত্যা করেছেন। জিয়াকে বাঁচালেন কর্নেল তাহের। তাঁকেও তিনি ফাঁসিতে ঝুলালেন। বাইশ বেঙ্গল নামে একটা বেঙ্গল ছিল। সেখানকার পঁচাত্তর পারসেন্ট সেনা ও অফিসার ছিল মুক্তিযোদ্ধা। ওটা পুরো ডেমেজ করে দিছেন জিয়া। খোঁজ নিয়া দেখেন ওই বেঙ্গলের নামটাও খুঁজে পাবেন না। আমার লগে মেজর মাহবুবকে মেরে ফেলা হয়েছে। মেজর ফজলু, মেজর বাচ্চু, ক্যাপ্টেন সিরাজ, তাজুল ইসলাম ও তাহেরকে চাকুরিচ্যুত করে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এইসবেরও বিচার হওয়া উচিত। তাঁর দল বিএনপিকে খেয়ে ফেলেছে জামাত। রাজাকারগো ছাড়া এখনও তারা চলতেই পারে না।”
শুধু বড় বড় রাজাকারদের বিচার করলেই চলবে না। প্রত্যেক জেলায় জেলায় রাজাকার ছিল। তাদেরও বিচার করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে এমনটাই মত দেন মোহন মিয়া। তিনি বলেন–
“রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী না থাকলে একাত্তরে এত মানুষ মরত না। আখাউড়ায় মোশাররফ ছিল নামকরা রাজাকার। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামসিদ। কসি মোল্লার বাবার নাম ঝাড়– মোল্লা। তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের প্রধান। আওয়ামী লীগে যোগ দিছিল রাজাকার মোবারক হাজি। রক্ষা পায় নাই। এহন জেলে। জামায়াতে রাজাকার আছে। বিএনপিতেও আছে। ওই রাজাকার আওয়ামী লীগে আসলেই মানুষ হইয়া যাইব, এটা ভাবলে চলব না। মনে রাখতে হবে, রাজাকার রাজাকারই থাকে।”
কথা ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে। যাঁরা দেশের ভেতর ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ করছেন মুক্তিযুদ্ধের তালিকায় তাঁরাই মূল সমস্যা বলে মনে করেন এই যোদ্ধা।
“১৯৭১ সালে হেমায়েত বাহিনী আর কাদেরিয়া বাহিনীতে কতজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আর এখন কতজন মুক্তিযোদ্ধার সনদ পাইছে খোঁজ নিয়ে দেখেন। রাজাকারগো নামও তালিকায় উঠছে। ডেকচি ঠিক করত পা লুলা। সেও এহন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের নৈতিক চরিত্রই তো নষ্ট হয়ে গেছে। সরকার কী করব?”
দেশে সন্ত্রাসী আর জঙ্গিদের উত্থান প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা মোহন মিয়া দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন–
“আমার কথা হুনেন, এ দেশে জঙ্গি নাই। আছে বিএনপি-জামাত। খেমতায় না যাইতে পারলে আমি এইতা করুম। এইডা যারা মনে করে তাগো থামাতেও হবে। যারা বলে এ সরকার অবৈধ তারাই তো চায় সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদ টিকে থাকুক। চাপে পড়ে সরকার খেমতা ছাড়ুক।”
স্বাধীন এই দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাললাগার অনুভূতি জানতে চাইলে উত্তরে এই সূর্যসন্তান মৃদু হেসে বলেন–
“দেশের উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে। মানুষ তিনবেলা খেতে পারছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। সারা পৃথিবী আজ আমাদের প্রসংশা করছে। এগুলো দেখলে সব কষ্ট ভুলে যাই।”
খারাপ লাগে কখন?
“যখন নব্য আওয়ামী লীগারদের দেখি। যারা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি করেই যাচ্ছে। এরা দল বেইচ্চা খায়। অথচ অনেক ত্যাগীরা আজও রাস্তায় ঘুরছে। দলের মানুষগুলা যদি শেখ হাসিনার মতো হওয়ার চেষ্টা করত তাইলে দেশের চেহারাই পাল্টে যেত।”
পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি পাহাড়সম আশা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহন মিয়ার। তিনি মনে করেন, প্রজন্মকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তাদের কাছে তুলে ধরতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সত্যিকারের ঘটনাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত প্রজন্মই পারবে সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়তে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৪ অক্টোবর, ২০১৬
© 2016 – 2019, https:.