ধানের ক্ষেতে মেঘের পাহাড়
এক ঝাঁক ওড়া বক দেখতে দেখতে দেখি কাছের পাহাড়টা মেঘ পুরো দখলে নিয়েছে। খানিক পরেই বাতাসের ধাক্কায় আমাদের দিকে ধেয়ে এলো। নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার আগেই ভিজিয়ে দিল। আমরা মোটেও মন খারাপ না করে তুরা পাহাড়ের খোঁজ করি। কিন্তু মেঘের দাপটে টিকিটিও দেখার জো নেই।
শাপলা বাজার মোড় পার হতেই দৃশ্যপট বদলে গেল। দুই পাশে পাহাড় আর পাহাড়। আকাশে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দু-একটি পাহাড়ে তখন মেঘের বসতি। এই সকালে সূর্যটাও তাজা। মেঘের ফাঁক গলে বেরিয়ে পড়ছে মাঝেমধ্যে। সহকর্মী সুমনা চিসিমের বাড়ি হালুয়াঘাট। সঙ্গে আছে দুই বন্ধু- সোহরাব আর মৃদুল।
হালুয়াঘাট কেন নাম- প্রশ্নটা উঁকি দিয়ে আছে সেই তখন থেকে। সুমনা সময়টাকে পিছিয়ে নিয়ে গেল- ১৬৫০ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি একটা সময়। কংস নদীতে দর্শা নামের একটা ঘাট ছিল। হালুয়া মানে চাষিরা নানা কাজে এ ঘাট ব্যবহার করত। সে থেকেই এ নাম। কেউ কেউ অবশ্য বলে, ঘাটটি হালুয়া নামের এক ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করত বলে নাম হয়েছে হালুয়াঘাট।
হালুয়াঘাট বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা করে যাই আচকিপাড়ায়। সুমনার বাবা হরিপদ রিছিলকে এলাকায় সবাই চেনে। বয়স ১০৪ বছর। নাশতা করার সময় আলাপ হলো।
নাশতার পর কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে পাড়া বেড়াতে বের হয় সুমনা। বলা বাহুল্য, আমরা পিছু নিই।
সুমনা বলে, সূর্যপুর, পানিহাটা আর কড়ইতলী থেকে মেঘালয়ের পাহাড় ভালো দেখা যায়। কড়ইতলী এগুলোর মধ্যে কাছে। বিজিবি ক্যাম্পের পাশ দিয়ে একটি ইটের রাস্তা গেছে শেরপুরের দিকে অন্যটি সূর্যপুর হয়ে ধোবাউড়া। পাহাড় থেকে সীমানাকে থোড়াই কেয়ার করে মাঝেমধ্যে নেমে আসে বন্য হাতি বা মায়াবী হরিণের দল। দুপুরের খাবার সেরে রওনা হই কড়ইতলী।
গ্রামটি গোবরাকুড়া ইউনিয়নে, হালুয়াঘাট শহর থেকে মোটে সাত কিলোমিটার। ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে রাস্তা। মাঝেমধ্যে কোথাও তাল, কোথাও খেজুর গাছ। ছবি না তুলে এগোতে পারি না। এক জায়গায় দৃশ্য সত্যি মনোহর- ধানক্ষেতে হাঁটু অবধি বৃষ্টির পানি। লম্বা লম্বা পা নিয়ে তাতে মাছ ধরে চলেছে অনেক সাদা বক। কী যে অদ্ভুত!
কড়ইতলীর দিকে যতই যাই ততই মনে হয় স্বপ্নদেশে চলেছি। পাহাড়গুলো এখানে আরো কাছে। মেঘের ‘পরে রোদের ছায়া ঢেউ তুলেছে। মৃদুলের এসএলআর যেন থামতে ভুলে গেছে। মাঠে মাঠে ধান বুনে চলেছে গারো নারী। সুমনা জানাল- গারো জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, নারীর হাতে রোপিত গাছ থেকে অধিক ফসল মিলে। চলতে চলতে একটি ছোট্ট খাল পেলাম। বাঁশ বিছিয়ে সাঁকো তৈরি হয়েছে তার ওপর। পথবন্ধু কিরিত তিছিম জানাল, খাল মনে হলেও এটি আসলে পাহাড় থেকে নেমে আসা ছোট্ট একটি নদী। বর্ষায় পাহাড়ি ঢলসমেত আছড়ে পড়ে কংসের বুকে। সে সময় লোকালয়ও ভাসিয়ে দেয়।
এক ঝাঁক ওড়া বক দেখতে দেখতে দেখি কাছের পাহাড়টা মেঘ পুরো দখলে নিয়েছে। খানিক পরেই বাতাসের ধাক্কায় আমাদের দিকে ধেয়ে এলো। নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার আগেই ভিজিয়ে দিল। আমরা মোটেও মন খারাপ না করে তুরা পাহাড়ের খোঁজ করি। কিন্তু মেঘের দাপটে টিকিটিও দেখার জো নেই।
বিকেল হতেই কড়ইতলী মানুষের আনাগোনা বাড়ে। নানা ঢং আর রঙের পোশাক তাদের গায়ে। অনেক জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেছে গারো নারী। আমরাও মিশে যাই মানুষের দলে। এটা-ওটা দেখে সন্ধ্যা নামিয়ে ফেলি। সুমনা তাড়া দেয়, পাহাড়গুলো ছাড়তে চায় না। তবু তো ফিরতে হয় যেমনটা হয় বরাবর।
ছবি: মৃদুল আহমেদ
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালের কন্ঠে, প্রকাশকাল : ৫ মে ২০১৪ তারিখে
© 2014 – 2018, https:.