ওটাই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা
মেঘনা নদীর পাড়ে গৌরিপুর গ্রাম। নরসিংদীর রায়পুর উপজেলার এ গ্রামেই জন্ম ইউনুছের। বাবা নাজির উদ্দিন চৌধুরী ব্যবসা করতেন ভৈরব বাজারে। ছোটবেলা থেকেই তার দুষ্টুমি ছিল আকাশছোঁয়া। স্কুল পালিয়ে নদী তীরের বালিতে ফুটবল আর হা-ডু-ডু খেলেই কাটত সময়। গ্রামে আম ও কাঁঠাল গাছ তেমন একটা ছিল না। বন্ধুদের নিয়ে তাই ইউনুছ আম-কাঁঠাল পেড়ে আনতেন পাশের দৌলতকান্দি, মহেষপুর, সাতমারা গ্রামের গাছগুলো থেকে। এ নিয়ে বিচার আসত ইউনুছের বাড়িতে। বাবা রাগ হতেন। কিন্তু তবুও ইউনুছের দুরন্ত মন কোনো বাধা মানে না।
এসব কারণে ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেন বাবা নাজির উদ্দিন। গ্রামে হাইস্কুল থাকা সত্ত্বেও প্রাইমারি পাসের পর ইউনুছকে তিনি ভর্তি করে দেন ভৈরব কাদিরবক্স হাইস্কুলে। ব্যবসার ফাঁকে বাবা ও চাচা আলতাফ হোসেন স্কুলে গিয়ে নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন তার।
তখন ভৈরব বাজার ছিল রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। ওখানকার বড় নেতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। স্কুলের ওপর তলাতেই ছিল হাজী আসমত কলেজ। ফলে রাজনীতির পুরো হাওয়াটাই টের পেতেন ইউনুছরা। তখন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলছেন শেখ মুজিব। ইউনুছদের বাড়ির পাশেই ছিল কোহিনুর জুটমিল। শ্রমিক নেতাদের বক্তব্য, দৈনিক বাংলা ও ইত্তেফাক পত্রিকা মারফত ইউনুছ জেনে যেতেন দেশের নানা খবরাখবর।
সময়টা ১৯৬৭। একবার শেখ মুজিব আসেন ভৈরবে। ভাষণ দেন স্কুল মাঠে। তাকে ফুল দেওয়ার দায়িত্ব পান ইউনুছরা। সেদিনই প্রথম খুব কাছ থেকে দেখেন এই মহান নেতাকে। স্টেইজের পাশেই বসে শুনেন তার ভাষণ। শেখের কন্ঠ উত্তাল করে দেয় ইউনুছের মনকে। শেখ মুজিবের একটি ভাষণই বদলে দেয় ইউনুছের জীবনের গতিপথকে।
ছোটবেলার নানা ঘটনার কথা শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুছ চৌধুরীর (ইনু) মুখে। একাত্তরে ইউনুছ ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী।
কথা ওঠে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুছ চৌধুরী বলেন, ‘ভাষণ শুনতে ওইদিন ভোরে ট্রেনের ছাদে উঠে আমরা চলে আসি কমলাপুর রেলস্টেশনে। সঙ্গে ছিলেন আব্দুস সামাদ, জিয়াউল হক, আশরাফসহ আরো অনেকে। কমলাপুর থেকে হেঁটে পৌঁছি রেসকোর্স ময়দানে। পিঁপড়ার মতো বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আসছিল। পুরো মাঠই ছিল লোকে লোকারণ্য।
সবার দৃষ্টি বঙ্গবন্ধুর দিকে। নেতা আজ কি বলবেন? বিকেলের দিকে বঙ্গবন্ধু ভাষণ শুরু করলেন। শেষে বললেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ আমাদের কাছে ওটাই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা।’
১ এপ্রিল থেকে প্রতিরোধ যুদ্ধ হয় ভৈরবে। এর নেতৃত্বে ছিলেন কেএম সফিউল্লাহ, হেলাল মোর্শেদ, নাজিম সাহেব, ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের শেলের আঘাতে তারা টিকতে পারে না। ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাদের হেলিকপ্টার নামে চর চারতলা ও গৌরিপুরে। তারা ক্যাম্প বসায় কোহিনুর জুটমিলে। পরদিন জ্বালিয়ে দেয় ভৈরব বাজার এলাকাটি।
ট্রেনিংয়ের কথা উঠতেই ইউনুছ বলেন, ‘মে মাসের প্রথম সপ্তাহের কথা। নৌকায় করে চর চারতলা পার হয়ে আড়াইশি তলার ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছি চাঁনপুর গ্রামের সামসু মিয়ার বাড়িতে। তিনিই সবাইকে সীমান্ত পার করিয়ে দিতেন। সে সময় ওপার থেকে ধনমিয়াসহ পরিচিত কয়েকজন ফিরে এসে খাবারের কষ্টের কথা বলেন। আমরা গৃহস্থের ছেলে। পোকা ধরা ভাত কিভাবে খাব? এসব চিন্তা করে আমিও ফিরে আসি বাড়িতে। কিন্তু বন্ধু আশরাফসহ বাকিরা চলে যায় মুক্তিযুদ্ধে। পরে আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হতে থাকে।’
আবার ট্রেনিংয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কোন সময়ে?
মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। যুবকদের পেলেই গুলি করত। এসব দেখে আমরা ঠিক থাকতে পারি না। জেঠাতো ভাই শহিদুল্লাহ, দৌলতকান্দি গ্রামের ফুলমিয়াসহ পরিকল্পনা করি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার। কিন্তু সঙ্গে কিছু টাকা নিতে হবে। কিভাবে পাই? পাকিস্তানিদের ভয়ে ভৈরবের ব্যবসা তখন চলে আসে আমাদের গ্রামে। বাবার কাছ থেকে পুঁজি নিয়ে রায়পুরা থেকে সিগারেট এনে আমরা কিছুদিন পাইকারি বিক্রি করতাম। কিছু টাকা জমতেই ৫ জুন সকালে রায়পুরা যাওয়ার কথা বলে আমরা ঘর ছাড়লাম।’
কোথায় ট্রেনিং করলেন?
‘দৌলতকান্দি পার হয়ে সুলতানপুর বাজার হয়ে আমরা বিশ্বরোডে উঠি। সেখানেই প্রথম শুনি রাজাকার শব্দটি। বাঙালি কয়েকজন যুবক অস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছিল সীমান্তের রাস্তাটি। পরে আমরা আখাউড়া সীমান্ত পার হয়ে চলে আসি ভারতের আগরতলায়। ৫ জুন রওনা দিয়ে ১১ জুন সেখানে পৌঁছি। কংগ্রেস ভবনে ২-৩ দিন থাকার পর আসি হাপানিয়া ক্যাম্পে। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন এ্যাডভোকেট আফতাব উদ্দিন ভুঁইয়া। সেখান থেকে দুর্গা চৌধুরী পাড়া, গোকুলনগর ট্রানজিট ক্যাম্প হয়ে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় লায়লাপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে। আমার এফএফ ছিল ৯৩৪৩৩। আমাদের ২৮ দিনের ট্রেনিং করায় ভারতের গোরকা রেজিমেন্ট। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন রবিন্দ্র শিং।
কোথায় কোথায় যুদ্ধ করেন?
তিনি বলেন, ‘ট্রেনিং শেষে আমাদের শপথ পড়ানো ও অস্ত্র দেওয়া হয় ৩নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার হেজামারায়। সেখান থেকে আমরা বাংলাদেশের ভেতরে কসবা এলাকায় ঢুকে আক্রমণ করে আবার সরে পড়তাম। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আসি নারায়ণপুর লক্ষ্মীপুরে। সেখানে আমরা ৬৫ জনের একটি ক্যাম্প তৈরি করি। আবুল কাশেম ভুঁইয়া ছিলেন গ্রুপ কমান্ডার। পরে ছোট ছোট আরও গ্রুপ আমাদের সাথে যুক্ত হয়।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় এক অপারেশনে স্পিøন্টারের আঘাত লাগে ইউনুছের কপালে। এছাড়াও তার মাজা, হাত ও পা ফ্রেকচার হয়ে যায়। সেই দিনের রক্তাক্ত অপারেশনটির কথা শুনি তার জবানিতে। তার ভাষায়, ‘১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১। দুপুর বেলা। ভৈরবে ছিল পাকিস্তানি সেনারা। রামনগর ব্রিজ পেরিয়ে তারা আমাদের দিকে অ্যাডভান্স হতে চায়। ব্রহ্মপুত্র নদের ওপরে ছিল ব্রিজটি। আমরা ব্রিজের দক্ষিণ পাশে রামনগরে পজিশন নেই। ওরা ব্রিজের উত্তরে ভৈরব অংশে। থেমে থেমেই গোলাগুলি চলছিল। সন্ধ্যা হয় হয়। কেউ কেউ নৌকা নিয়ে ওপারে যাওয়ারও চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের আর্টিলারির আঘাতে এগোতে পারে না। রেল ব্রিজ দিয়ে ওপারে যেতে পারলেই ওদের ওপর সহজে আক্রমণ চালানো যাবে, এই পরিকল্পনা করে আমরা একটি দল ব্রিজের ওপর দিয়ে এগোতে থাকি। হঠাৎ একটা বুলেট আমার কানের পাশ দিয়ে শো করে চলে যায়। পেছনে তাকাতেই দেখলাম গুলিটি গিয়ে লেগেছে সহযোদ্ধা আবু হানিফের গায়ে। ও ছিটকে পড়ল। আমরা তবুও থামি না।
পাকিস্তানি সেনারা তখন ভৈরব বাজার থেকে অনবরত শেল মারতে থাকে। একটা শেল আইসা পড়ে ব্রিজের ওপর আমার সামনে। বিকট শব্দে নড়ে ওঠে ব্রিজটি। একটি স্পিøন্টার এসে লাগে আমার কপালে। আমি টের পাই না। হাত দিয়ে দেখি রক্ত। ব্রিজটি তখন নড়ছিল। আমি আর নিজেকে সামলে নিতে পারি না। ঝাঁকুনিতে পড়ে যাই একেবারে নিচে। চুপসা পানিতে ছিল পাথর। ফলে আমার মাজা, হাত ও পা ফ্র্যাকচার হয়ে যায়। পরেই আমি জ্ঞান হারাই। যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমি ক্যাম্পে। আমার সারা শরীর প্লাস্টারে আবৃত।’
কথা ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ বলেন, ‘আমাদের গ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল ৩৪ জন। কিন্তু তালিকায় এ সংখ্যা আরও বেশি। কিভাবে হলো? শ্বশুর ছিল থানা কমান্ডার তাই জামাই পেয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের সনদ। যুদ্ধের পর পরই এ তালিকা চূড়ান্ত করা উচিত ছিল। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা ছিল প্রতি সেক্টরে। রাজনৈতিক কারণে এখনো বাড়ছে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা। এখন একটি ফরমে ৫ জন সাক্ষীর নাম ও স্বাক্ষর থাকলেই মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায়। টাকার বিনিময়ে সহজেই মেলে এই স্বাক্ষর। তাই তালিকা বাড়ার পেছনে দায়ী মুক্তিযোদ্ধারাই।’
বেয়াল্লিশ বছর পরে বিচার হচ্ছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার ও আলবদরদের। রাজাকারদের বিচার নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ইউনুস অকপটে জানান নিজের মতামতটি। তার ভাষায় ‘স্বাধীনের পরই এদের বিচার করা উচিত ছিল। বঙ্গবন্ধু তা শুরুও করেছিলেন। সে সময় কুষ্টিয়ার রাজাকার চিকন আলীর ফাঁসির আদেশও হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয় ৩৭ হাজার ৪৭১ জন রাজাকারকে। পরবর্তীতে ৭৫২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার কারণে ২৫ হাজার ৭১৯ জন ছাড়া পেলেও আটক প্রায় ১১ হাজার রাজাকারের বিচার তখনো চলছিল।’
তবে কেন বিচার হলো না?
উত্তরে তিনি বলেন, ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। তিন মাসের মাথায় জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই দালাল আইন বাতিল করেন। ফলে অভিযুক্ত, এমনকি দ ৭৫২ জনকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। সে সুযোগে মুক্ত হন চিকন আলীও।’
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগা অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই বীর বলেন, ‘যখন দেখি কন্ঠ আকাশে তুলে নতুন প্রজন্ম জয় বাংলা স্লোগান তুলছে তখন মনটা ভরে যায়। বেয়াল্লিশ বছর পরে হলেও রাজাকারদের বিচারের জন্য গণজাগরণ মঞ্চের তরুণরা যখন আন্দোলন গড়ে তোলে- তখন বুকটা ভরে ওঠে। খারাপ লাগা জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ বলেন, ‘আমাদের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতারা টাকা কামানোর কথা চিন্তাও করত না। বরং নানাভাবে সাহায্য করত গরিব ছাত্রদের। এখন পাতি নেতারাও কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এসব দেখলে সত্যি কষ্ট লাগে ?’
নতুন প্রজন্মের প্রতি আশা নিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুছ চৌধুরী বলেন, ‘তোমরা লেখাপড়া করে নিজেকে তৈরি কর। শুধু নিজের কথা ভেবো না। বিদেশের লোভে না পড়ে দেশের জন্য কিছু করো। মনে রেখো এ দেশটার কাছে আমরা সবাই দায়বদ্ধ।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক এই সময় এ, ১২ মার্চ ২০১৪, বর্ষ ০১ সংখ্যা ১১
© 2014 – 2021, https:.