সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান ছিল প্রবল
প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ মুর্শিদাবাদ খোশবাসপুর গ্রামে ১৯৩০ সালের অক্টোবর মাসে জন্মগ্রহণ করেন ৷ প্রথম জীবনে বাড়ি থেকে পলাতক কিশোরের জীবন অতিবাহিত করেছেন ৷ রাঢ় বাংলার লোকনাট্য “আলকাপের” সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাচ-গান-অভিনয়ে নিমজ্জিত হয়ে জেলায় জেলায় ঘুরেছেন ৷ তিনি ছিলেন ‘আলকাপ’ দলের “ওস্তাদ” (গুরু) । নাচ-গানের প্রশিক্ষক । নিজে আলকাপের আসরে বসে হ্যাসাগের আলোয় দর্শকের সামনে বাঁশের বাঁশি বাজাতেন । নিজের দল নিয়ে ঘুরেছেন সারা পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, এমনকি বিহার-ঝাড়খন্ডেও । তাই পরবর্তী জীবনে কলকাতায় বাস করলেও নিজেকে কলকাতায় প্রবাসী ভাবতেই ভালবাসতেন । তাই সুযোগ পেলেই বার বার মুর্শিদাবাদের গ্রামে পালিয়ে যেতেন । সেই পলাতক কিশোর তাঁর চরিত্রের মধ্যে লুকিয়ে ছিল । ঘুরতেন সেই রাখাল বালকের মাঠে, হিজলের বিলে, ঘাসবন ও উলুখড়ের জঙ্গলে, পাখির ঠোঁটে খড়কুটো আর হট্টিটির নীলাভ ডিম -সেই মায়াময় আদিম স্যাঁতসেতে জগতে ।
তাঁর পিতার সঙ্গে বর্ধমানের কর্ড লাইনে নবগ্রাম রেল স্টেশনের কাছে কিছুদিন ছিলেন । সেখানে গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন । সেই নবগ্রাম গোপালপুরের প্রেক্ষাপটে তিনি লিখেছিলেন ‘প্রেমের প্রথম পাঠ’ উপন্যাস । গোপালপুর থেকে পাশ করে তিনি ভর্তি হন বহরমপুর কলেজে ।
মুস্তাফা সিরাজ কলকাতায় পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন ষাটের দশকের শুরুতে ৷ দীর্ঘদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে চাকরি ও লেখালেখি সমানতালে চালিয়ে গেছেন ৷ তাঁর জ্ঞান ও অধীত বিদ্যাসমূহ তাঁকে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী হিসাবে বিদ্বানসমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে ৷ইতিহাস,সমাজতত্ত্ব , নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, বিজ্ঞান, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব – সব বিষয়েই তাঁর জ্ঞান ও বিদ্যার গভীরতা তাঁকে পন্ডিতমহলে পরিচিত করে তুলেছে৷সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের লেখক সত্তায় জড়িয়ে ছিল রাঢ়ের রুক্ষ মাটি । মুর্শিদাবাদের পাশের জেলা বীরভূম, যেখানে লাভপুর গ্রামে তারাশঙ্করের জন্ম । একই জলহাওয়া তাঁদের দুজনকেই প্রাণোন্মাদনা দিয়েছিল । তাই তারাশঙ্কর বলতেন, “আমার পরেই সিরাজ, সিরাজই আমার পরে অধিষ্ঠান করবে ।”
তাঁর লেখা ‘তৃণভূমি” উপন্যাসে কান্দী মহকুমার এক বৃহৎ অঞ্চল ধরা আছে । “উত্তর জাহ্নবী” উপন্যাসে ধরা আছে এক বিশেষ সময় ও সমাজের কথা, যা বাংলা সাহিত্যে অনাস্বাদিত । আর “অলীক মানুষ” এক বিস্তৃত ভুবনের কাহিনী, যা এক মুসলিম পীর বা ধর্মগুরুর বংশে জাত পুরুষের আত্মানুসন্ধান । ব্রিটিশের রাজত্বের শেষভাগে এক পরিবর্তনীয় সময়ের নিখুঁত স্থির ছবি । এই অলীক মানুষ তাঁকে ভিন্ন লেখকের মর্যাদার চূড়ান্ত শিখরে উন্নীত করেছে ।
ক্ষুদে ও কিশোর পাঠকদের দাবি মেটাতে তিনি সৃষ্টি করলেন “গোয়েন্দা কর্নেল” নামে একজন রহ্স্যময় চরিত্র , যাঁর মাথা জোড়া টাক, ঠোঁটে চুরুট, অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি অফিসার, এখন প্রজাপতি ও পাখি দেখতে ভালোবাসেন ৷ অথচ তিনি অনেক অপরাধ ও হত্যার কিনারা করে শখের গোয়েন্দাগিরি করেন ৷”গোয়েন্দা কর্নেল” পাঠকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ৷
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান ছিল প্রবল । সংবাদপত্রে চাকরি করলেও কোনও মালিকানাগোষ্ঠীর কাছে মাথা নিচু করেন নি । ‘অলীক মানুষ’ উপন্যাস ছাপা হয় ধারাবাহিকভাবে ‘চতুরঙ্গ’ নামে একটি লিট্ল ম্যাগাজিনে । “তৃণভূমি” ছাপা হয় অধুনালুপ্ত ‘ধ্বনি’ নামক এক ছোট পত্রিকায় । বড় পত্রিকায় চাকরি করলেও তাঁর সেরা উপন্যাসগুলি ছাপা হয়েছে ছোট পত্রিকায় । লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকদের প্রতি ছিল তাঁর সস্নেহ পক্ষপাত । মিডিয়ার আলো ও প্রচারের প্রতি তাঁর আকুলতা ছিল না । নিজের আত্মসম্মানবোধ নিয়ে প্রায় একা উন্নত গ্রীবায় ছোট ফ্ল্যাটে জীবনকে কাটিয়ে গেছেন । মাথা উঁচু করে থাকার দর্পী মনোভাবের জন্য তাঁকে অনেক মনোকষ্ট পেতে হলেও তিনি দমে যাননি । তবে তাঁর পাঠকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল মধুর । তাঁর ব্যবহারে ও আচরণে ছিল পরিশীলিত ভদ্রতা ও আন্তরিকতা ।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘অলীক মানুষ’ উপন্যাসটি ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্কিম পুরস্কার – এসব ছাড়াও ভুয়ালকা পুরস্কার দ্বারা সম্মানিত । তাঁর ‘অমর্ত্য প্রেমকথা’ বইয়ের জন্য জন্য তিনি পেয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত নরসিংহদাস স্মৃতিপুরস্কার । এছাড়া ১৯৭৯ সালে পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার । পেয়েছেন বিভূতিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার,সুশীলা দেবী বিড়লা স্মৃতি পুরস্কার, দিল্লির OUF সংস্থার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুরস্কার, শরৎচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার ইত্যাদি আরও অনেক পুরস্কার তিনি তাঁর সামগ্রিক সাহিত্য-কৃতিত্বের জন্য পেয়েছেন । তাঁর অনেক কাহিনী চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে , যেমন ‘কামনার সুখ দুঃখ’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘শঙ্খবিষ” । দীনেন গুপ্তের পরিচালনায় ‘নিশিমৃগয়া’ । উত্তমকুমার অভিনীত ‘আনন্দমেলা’ । অঞ্জন দাশ পরিচালনা করেছেন সিরাজের ছোটগল্প ‘রানীরঘাটের বৃত্তান্ত’ অবলম্বনে ‘ফালতু’ । সিরাজের “মানুষ ভূত” কাহিনী চলচ্চিত্র ছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে মঞ্চে ক্রমাগত অভিনীত হয়ে চলেছে ৷ এই স্কুল পালানো মানুষটিই পেয়েছিলেন সাম্মানিক ডক্টরেট ।
৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে তিনি পরলোক গমন করেন।
লেখা ও ছবি : সংগৃহীত
© 2012 – 2018, https:.