শহীদ জননীর কথা
জাহানারা ইমাম শহীদ জননী, লেখিকা, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ একাত্তরের দিনগুলি। একাত্তরে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শফি ইমাম রুমী দেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন এবং কয়েকটি সফল গেরিলা অপারেশনের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন।পরবর্তীতে তাকেঁ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর রুমীর বন্ধুরা রুমীর মা জাহানারা ইমামকে সকল মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন৷ জাহানারা ইমাম হন ‘শহীদ জননী’।
জাহানারা ইমামের জন্ম ১৯২৯ সালের ৩ মে। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে। তাঁর ডাক নাম ছিল জুড়ু । জাহানারা ইমামের বাবা সৈয়দ আবদুল আলী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা সৈয়দা হামিদা বেগম। জাহানারা ইমাম মাট্রিক পাস করেন ১৯৪২ সালে। ১৯৪৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পাস করে তিনি ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে। সেখান থেকে বিএ পাস করেন ১৯৪৭ সালে। ১৯৬০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৬৪ সালে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন।
জাহানারা ইমাম শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ময়মনসিংহ শহরের বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে। সেখানে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ১৯৪৮ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, বুলবুল একাডেমী কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। তিনি কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটেও খন্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন।
রংপুরের ছেলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার শরীফুল আলম ইমাম আহমদের সঙ্গে জাহানারা ইমামের বিয়ে হয় ১৯৪৮ সালে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর প্রথম সন্তান রুমী দেশকে শত্র“মুক্ত করার শপথে ঘর ছাড়েন। দুঃসাহসী গেরিলা ছিলেন তিনি। এক সময় পাকিরা অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে রুমীকে হত্যা করে।
জাহানারা ইমামের স্বামীকে ধরে নিয়ে গিয়েও পাকিস্তানিরা নির্মম নির্যাতন চালায়। বিজয়ের মাত্র তিনদিন পূর্বে তিনি ইন্তেকাল করেন। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে জাহানারা ইমাম মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন।
২৯ ডিসেম্বর ১৯৯১ সাল। গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামীর আমীর ঘোষণা করা হয়। ফলে সূত্রপাত হয় জনবিক্ষোভের। বিক্ষোভের অংশ হিসাবে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারিতে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয় জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে। তিনি হন এর আহ্বায়ক। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে ১১ ফেব্রুয়ারিতে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জাহানারা ইমাম।
এই কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ ‘গণআদালত’ এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠান করে। গণআদালাতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দশটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ১২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদন্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন।
জাহানারা ইমাম গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। এই গণআদালতের সদস্য ছিলেনঃ এডভোকেট গাজিউল হক, ড: আহমদ শরীফ, মাজহারুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সুফিয়া কামাল, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, শওকত ওসমান, লে: কর্ণেল (অব:) কাজী নুরুজ্জামান, লেঃ কর্ণেল (অবঃ) আবু ওসমান চৌধুরী এবং ব্যারিস্টার শওকত আলী খান।
গণআদালত অনুষ্ঠিত হবার পর সরকার ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে অ-জামিনযোগ্য মামলা দায়ের করে। পরবর্তীতে হাইকোর্ট ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির জামিন মঞ্জুর করেন। এরপর লাখো জনতার পদযাত্রার মাধ্যমে জাহানারা ইমাম ১২ এপ্রিল ১৯৯২ সালে গণআদালতের রায় কার্যকর করার দাবিসংবলিত স্মারকলিপি পেশ করেন জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পীকার, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে। ১০০ জন সাংসদ গণআদালতের রায়ের পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেন। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেশব্যাপি গণস্বাক্ষর, গণসমাবেশ, মানববন্ধন, সংসদ যাত্রা, অবস্থান ধর্মঘট, মহাসমাবেশ ইত্যাদি কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে আন্দোলন আরো বেগবান হয়।
২৬ মার্চ ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা দিবসে গণআদালত বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেত্রত্বে গণতদন্ত কমিটি ঘোষিত হয় এবং আরো আটজন যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করা হয়। এই ঘৃণ্য আটজন যুদ্ধাপরাধীর নামঃ আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মো: কামরুজ্জামান, আবদুল আলীম, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, মওলানা আবদুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ এবং আবদুল কাদের মোল্লা।
২৮ মার্চ ১৯৯৩ সালে নির্মূল কমিটির সমাবেশে পুলিশ হামলা চালায় । পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন জাহানারা ইমাম, এবং তাঁকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি বিদেশেও গঠিত হয় নির্মূল কমিটি এবং শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন। পত্র-পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম হয়ে উঠলে আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেন জাহানারা ইমাম। গোলাম আযমসহ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবির আন্দোলনকে সমর্থন দেয় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে।
২৬ মার্চ ১৯৯৪ সালে স্বাধীনতা দিবসে গণআদালতের ২য় বার্ষিকীতে গণতদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান কবি বেগম সুফিয়া কামাল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনে রাজপথের বিশাল জনসমাবেশে জাহানারা ইমামের হাতে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট হস্তান্তর করেন। এ সময় শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটলে জাহানারা ইমামকে চিকিৎসার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ডেট্টয়েট হাসপাতালে নেয়া হয়। ২৬ জুন ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় মিশিগানের ডেট্টয়েট নগরীর সাইনাই হাসপাতালের বেডে ৬৫ বছর বয়সে জাহানারা ইমাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যে দাবীতে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, তাই আজ বাস্তবায়নের পথে। যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ইত্যেমধ্যে মানবতা বিরোধী অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের।
জাহানারা ইমামের লেখা বইয়ের মধ্যে বীরশ্রেষ্ঠ (১৯৮৫), একাত্তরের দিনগুলি (১৯৮৬), গজকচ্ছপ (১৯৬৭), সাতটি তারার ঝিকিমিকি (১৯৭৩), একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি (১৯৮৯), জাগ্রত ধরিত্রী (১৯৬৮), তেপান্তরের ছোট্ট শহর (১৯৭১), নদীর তীরে ফুলের মেলা (১৯৬৬), অন্য জীবন (১৯৮৫), জীবন মৃত্যু (১৯৮৮), ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস (১৯৯১) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
তথ্য ও ছবি : সংগৃহীত
© 2012 – 2021, https:.