একটি ভুল, প্রশ্ন অনেকগুলো !
বৈশাখ মাস। প্রচন্ড রোদ। তবুও চারপাশে শীতল অনুভূতি। বড় বড় আমগাছ। সংখ্যায় দুই হাজারের মতো। অধিকাংশই শতবর্ষী। দিনময় এখানে চলে পাখিদের কোলাহল। ছায়াঘেরা পাখিডাকা আম্ররকানন এটি। খরতাপও এখানে কুর্নিশ নোয়ায়। প্রচন্ড গরমে তাই আগতরা আশ্রয় নেয় আম্রকাননের শীতলতায়।
১৭ এপ্রিল ১৯৭১। এ আম্রকাননেই আশ্রয় মিলে বাংলাদেশের ইতিহাসের নক্ষত্রদের। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ (প্রবাসী) সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিরা শপথ নেন এখানেই। সে থেকে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন নাম পাল্টে হয়ে যায় মুজিবনগর।
আম্রকাননের একপাশে স্মৃতিসৌধ। অন্যপাশে মুজিবনগর কমপ্লেক্সের মূল ভবন। ভেতরের মেঝেতে বাংলাদেশের বড় একটি মানচিত্র। মানচিত্রে ছোট ছোট ভাস্কর্য বসানো। এভাবে দেখানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা ঘটনা। ভবনের উত্তরপার্শ্বের সন্মুখ অংশে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের একেকটি অধ্যায়কে। সবই ধবধবে সাদা বর্ণে। ভাস্কর্যের মাধ্যমে। যেন একেকটি জীবন্ত ইতিহাস। দেশের গৌরবময় ইতিহাসকে ধরে রাখতে মুজিবনগর কমপ্লেক্সের সার্বিক উদ্যোগ সত্যি অসাধারণ!
প্রতিদিন শত শত মানুষের পায়ের ছাপ পড়ে মুজিবনগরে। দেশি-বিদেশি পর্যটক ছাড়াও শিক্ষাসফরে আসেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা। এক বিকেলে আমরাও ঘুরে দেখি কমপ্লেক্সেটির স্থাপনাগুলো।
ভবনের উত্তর পাশে মানুষের জটলা। একদল ছাত্র-ছাত্রী। সঙ্গে কয়েকজন শিক্ষক। দূর থেকে তারা দেখছে সাদা ভাস্কর্যগুলোকে। এক শিক্ষক আবার বর্ণনা করছেন ভাস্কর্যের পেছনের ইতিহাসটিকে। ভাস্কর্যে ইতিহাস দেখা। নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস শিখানোর এ এক অনন্য পদ্ধতি।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, গণহত্যা, অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিপরিষদ, গার্ড অব অনার, ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া সম্মেলন শেষে আমাদের দৃষ্টি আটকায় আত্মসমর্পণের ভাস্কর্যটির দিকে। একটি টেবিলকে সামনে রেখে দুটি চেয়ারে বসা অবস্থায় রয়েছেন পূর্বাঞ্চলের সম্মিলিত বাহিনী প্রধান লেঃ জেনারেল জগজিত সিং অরোরা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লেঃ জেঃ এ কে নিয়াজী। আত্মসমর্পণের দালিলিক এ চিত্রটিই আমাদের জানা। কিন্ত এখানকার ভাস্কর্যে ওই দুজন ছাড়াও টেবিলের পাশে চেয়ারে বসা তৃতীয় এক ব্যক্তিকে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ঢাকা থেকে আগত একজন দর্শনার্থীরও চোখ আটকায় আত্মসমর্পণের ভাস্কর্যটির দিকে। নাম তাঁর আসমা ইসলাম। মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্রনাথ কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক তিনি। বললেন নিজের অনুভূতির কথা ‘এটি একটি বড় ভুল। ইতিহাসে কখনো হস্তক্ষেপ করা যায় না। ইতিহাসের এ রকম ভুল উপস্থাপন বিভ্রান্তিতে ফেলবে পরবর্তী প্রজন্মকে।’
সাধারণত কোন তথ্য বা ছবি থেকেই নির্মাণ করা হয় ভাস্কর্য। তাই আমার একটু ফিরে দেখি ইতিহাসে আত্মসমর্পণের সে দিনটির দিকে।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহোওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্য বিনা শর্তে সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। সম্মিলিত বাহিনীর পক্ষে এই আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন লেঃ জেনারেল জগজিত সিং অরোরা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেঃ জেঃএ কে নিয়াজী। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন মুক্তিবাহিনীর উপ-সেনা প্রধান ও বিমান বাহিনী প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এস ফোর্স অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল কে এম সফিউল্লাহ, ২নং সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর এ টি এম হায়দার এবং টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী। উল্লেখিত তথ্যটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবের।
গত ২৬ মার্চ ২০১২ এ প্রথমআলোর স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় ‘আত্মসমর্পণের টেবিল’ শিরোনামে লেঃ কর্নেল কে এম সফিউল্লাহ তাঁর লেখায় আত্মসমর্পণ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন ঠিক এভাবে, ‘রেসকোর্স ময়দানে আমরা প্রবশে করি এখন যেখানে পুলিশ কন্ট্রোল ক্যাম্প, সেদিক দিয়ে। পশ্চিম পাশে একটি গেট ছিল। পূর্বদিকে কিছুদূর যাওয়ার পর, অর্থাৎ পুলিশ ক্যাম্পের পূর্ব পাশে একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার রাখা। সেই টেবিল ও চেয়ার কোথা থেকে আনা হয়েছে, সেটি আমি জানি না। জেনারেল অরোরা ও নিয়াজি সরাসরি টেবিলের সামনে পাতা চেয়ারে গিয়ে বসেন। দু-তিন মিনিট পর জেনারেল নিয়াজি যৌথ কমান্ডের (বাংলাদেশ- ভারত) কাছে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। তখন আমার ঘড়িতে সময় চারটা ৩১ মিনিট। নিয়াজি স্বাক্ষর করা মাত্র চারদিকে জয়বাংলা স্লোগানে মুখর হতে থাকল।’ একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে কে এম সফিউল্লাহর লিখা থেকেও তৃতীয় কোন চেয়ার কিংবা ব্যক্তির অস্তিত্বের প্রমাণ নেই।
এছাড়া আত্মসমর্পণের দলিল হিসেবে সে সময়কার ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, দুটি চেয়ারে বসা অবস্থায় শুধুই অরোরা ও নিয়াজী। আর দেশি-বিদেশি সাংবাদিকগণ ক্যামেরা ও রেকর্ডার হাতে হাটু গেড়ে বসেছেন টেবিলের চারপাশে।
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। নিউ ইয়োর্ক টাইমসে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল ‘ম্যান এট এ টেবিল’। খবরটিতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে শুধুমাত্র অরোরা ও নিয়াজিই টেবিলের সামনে দুটি চেয়ারে বসে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, দেশি- বিদেশি কোন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদেও খুঁজে পাওয়া যায়নি তৃতীয় কোন চেয়ার কিংবা ব্যক্তির অস্তিত্ব।
যদি তাই হয়, তবে মুজিবনগর কমপ্লেক্সে আত্মসমর্পণ ভাস্কর্যে ইতিহাসের একটি ভুল তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। আর এই একটি ভুলে প্রশ্ন থেকে যায় অনেকগুলো। কোন ছবি থেকে এমন ভাস্কর্য তৈরি হলো ? এমন বিভ্রান্তিমূলক ছবি ও তথ্য সরবরাহ করল কে ? তৃতীয় চেয়ারে বসা ব্যক্তিটি বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? এটি কি ইতিহাসকে বিকৃতির চেষ্টা নয়? দেশের ইতিহাস রক্ষার দায়িত্বে কারা আছেন? কবে সংশোধিত হবে মুজিবনগরের আত্মসমর্পণের এই ভাস্কর্যটি?
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সচলায়তন.কমে ৬ জুন ২০১২, ২.০৪ অপরাহ্নে
© 2012 – 2021, https:.